জীবহত্যা পাপ নয়, প্রাণীহত্যা মহাপাপ: বৌদ্ধদের নিত্যপালনীয় ৫টি শীল বা নিয়ম না মানলে বৌদ্ধ হওয়ার প্রাথমিক শর্ত ভঙ্গ করা হয়। একজন ব্যক্তি ত্রিশরণ গ্রহণের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মে প্রবেশ করে আর প্রতিদিন পঞ্চশীল পালনের মাধ্যমে বৌদ্ধ হিসেবে জীবন ধারণ করে। পঞ্চশীল পালন ব্যতিত কেউ বৌদ্ধ দাবী করতে পারে না।
পঞ্চশীল বা অবশ্যই পালনীয় নিয়ম
১. প্রাণি হত্যা করবো না।
২. না দেওয়া বস্তু গ্রহণ করবো না। (চুরি করবো না।)
৩. মিথ্যা কামাচার থেকে বিরত থাকবো। (অবৈধ যৌনাচার থেকে বিরত থাকবো।)
৪. মিথ্যা বাক্য বলা থেকে বিরত থাকবো।
৫. নেশা গ্রহণ বা সেবন থেকে বিরত থাকবো।
আজকে আমরা আলোচনা করবো পঞ্চশীলের প্রথম শীল নিয়ে।
বুদ্ধ প্রাণির প্রতি দয়া প্রদর্শনের জন্য পৃথিবীজুড়ে শ্রদ্ধার ও পূজার পাত্র হয়েছেন। কিন্তু কিছু কিছু সমালোচক বুদ্ধের এই প্রাণি দয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। আমরা যারা বুদ্ধের পথ অনুসরণ করি, এই প্রশ্নটির সম্মুখিন কম বেশি অনেকেই হয়েছি।
তারা আমাদের প্রশ্ন করেন, জীব হত্যা যদি মহা পাপ হয়, বৌদ্ধরা শাকসবজি, লতাপাতা কেমনে গ্রহণ করে। তাদেরও তো জীবন আছে। তখন আমরা অনেকেই উত্তর দিতে পারি না।
এই প্রশ্নটি আমি বৈজ্ঞানিক, যুক্তিপূর্ণ ও বৌদ্ধমতেই দিতে চেষ্টা করি। হয়তো তথাগত বুদ্ধ সেই জন্যই প্রথম শীলটি “জীব হত্যা থেকে বিরত থাকবো” না বলে “প্রাণি হত্যা থেকে বিরত থাকবো” বলেছেন।
জীবহত্যা না বলে বুদ্ধ প্রাণি হত্যা কেন বলেছেন-
একদিন ফেইজবুকে আমি বুদ্ধের পঞ্চনীতি সহ একটি পোষ্ট দিয়েছিলাম। আমার কয়েকজন বন্ধু বুদ্ধের প্রথম নীতিটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
পঞ্চশীলের প্রথম শীলের পালি: “পানাতাপাতা বেরমনী সিক্খাপদং সমাদিযামি।”
বাংলা:-“প্রাণিহত্যা থেকে বিরত থাকবো, এই শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।”
এখানে “পানাতিপাতা” শব্দের অর্থ “প্রাণীহত্যা”। আমার সে সব বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেন, যদি প্রাণীই হত্যা না করেন, আপনারা খান কি? আসলেই প্রশ্নটা যৌক্তিক।
তাহলে নীতিটা ব্যাখ্যা করা যাক। বিজ্ঞানীরা জীব জগতকে পাচঁটি রাজ্যে ভাগ করেছে যথা: ১। মনেরা ২। প্রোটিস্টা ৩। ফানজাই বা ছত্রাক ৪। প্লান্টি (উদ্ভিদ) ও ৫। এ্যনিমেলিয়া (প্রাণি)। খাদ্য প্রসংগে যেহেতু প্রশ্নটা তাই এখানে শেষের দুটি রাজ্য নিয়ে আলোচনা হবে।
মনেরা: যে সব প্রাণি একটি মাত্র কোষ নিয়ে গঠিত তাদের মনেরা রাজ্যের প্রাণি বলে। এই প্রাণি গুলো সাধারণত এতই ছোট হয় যে, তাদের খালি চোখে দেখা যায় না। আর্কিব্যাকটেরিয়া, মাইকোপ্লাজমা, ব্যাকটেরিয়া, সায়ানোব্যাকটেরিয়া, অ্যাকটিনোমাইসিটিস এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।
প্রোটিস্টা: আদ্যপ্রাণী বা প্রোটিস্টা হল বিভিন্ন ধরনের সরল, ইউক্যারিওট, এককোষী, আণুবীক্ষণিক জীবের শ্রেণী যাদেরকে ছত্রাক, প্রাণী বা উদ্ভিদ কোন বিভাগেই ফেলা যায় না। অ্যামিবা, প্যারামিসিয়াম এবং ইউগ্লিনা এই রাজ্যের জীব।
প্লান্টি (উদ্ভিদ): প্লান্টি অর্থ উদ্ভিদ জগৎ। গাছ পালা, লতাপাতা, শাক সবজি এই রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত। যেখানে আমিষ সহ সব ধরনের খাদ্য উপাদান বিদ্যমান। এই রাজ্যের জীবের জীবন আছে কিন্তু তীব্র অনুভুতি বা নাই। এরা প্রাণি নয় কিন্তু জীব।
এ্যানিমেলিয়া (প্রাণি): এ্যানিমেলিয়া শব্দের অর্থ প্রাণীজগৎ। যার তীব্র অনুভুতি আছে, জীবন বাচাঁতে ছুটাছুটি করে। এরা জীব এবং প্রাণি উভয়। যেমন: মানুষ, গরু, ছাগল, পিঁপড়া, পাখি, মাছ ইত্যাদি।
পৃথিবী যেমন নক্ষত্র নয় কিন্তু সৌরজগতের সদস্য। আবার সূর্য এক সাথে নক্ষত্র এবং সৌরজগতের সদস্য উভয়। তেমননি এ্যানিমেলিয়া জীব জগতের সদস্য এবং প্রাণি। কিন্তু প্লান্টি কেবল জীব এরা প্রাণি নয়।
অর্থাৎ উপরের ৫টি রাজ্য মিলে জীব জগৎ। উদ্ভিদ ও প্রাণি তাদের অন্তর্ভুক্ত দুটি রাজ্য। জীব হত্যা বলতে উপরের ৫টি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত যে কোন জীবকে হত্যা বুঝায় কিন্তু প্রাণি হত্যা বলতে কেবল এ্যানিমেলিয়া রাজ্যের জীবকে হত্যা বুঝায়। বুদ্ধ কেবল এ্যানিমেলিয়া রাজ্যের কথা উল্লেখ করেছেন।
ভাবতে অবাক লাগে জীব জগতকে বুদ্ধ তথাকথিত বিজ্ঞানিদের কত শত বছর আগে বিভাগ করে গেছেন। জীব এবং প্রাণিকে বুদ্ধ আলাদা করেছেন আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে।
বুদ্ধ “পানাতিপাতা” বলতে “প্রাণিহত্যা” বুঝিয়েছেন। যদি জীব হত্যা মহাপাপ বলতেন তবে বৌদ্ধরা না খেয়ে মরতেন। কারন জীব বলতে উপরের ৫টি রাজ্যকে বুঝানো হয়। তাই বৌদ্ধ পণ্ডিতদের, ধর্ম পর্যালোচনা বা গ্রন্থ প্রণয়নের সময় জীব হত্যা না বলে প্রাণীহত্যা লিখা উচিত। কারন পালিতে শব্দটা “পানাতিপাতা”।
বুদ্ধমতে প্রাণি বলতে কি বুঝায়
যার মধ্যে ৫ টি উপাদান বিদ্যমান বুদ্ধমতে সেই বস্তুকেই প্রাণী বলে। সেই পাচটি উপাদান হল-
১. বস্তু বা দেহ
২. অনুভুতি
৩. চেতনা বা সংজ্ঞা
৪. স্বভাব বা অভ্যাস এবং
৫. মন বা চিত্ত।
সহজভাবে- চিত্ত + বস্তু = প্রাণী। কিন্তু উদ্ভিদ এবং ডিমের মধ্যে চিত্ত নাই।
তাই বুদ্ধ জীব হত্যা মহাপাপ না বলে, প্রাণি হত্যা মহাপাপ বলেছেন। তবে বিনা প্রয়োজনে জীব (গাছপালা, লতাপাতা) নষ্ট করতেও বুদ্ধ মানা করেছেন।
কাজেই বৌদ্ধরা খাদ্য হিসেবে প্লান্টি বা উদ্ভিদকে গ্রহণ করতে ধর্মীয়ভাবে কোন বাঁধা নাই। তাছাড়া উদ্ভিদকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে কোন সংঘর্ষও নাই। কেউ কেউ ভাবতে পারেন আপনি প্রাণি হত্যা না করে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সব খাদ্য উপাদান উদ্ভিদ থেকে পাবেন কিভাবে?
উদ্ভিদ জগতে খাদ্যের মোট ৫টি উপাদনের সব ক‘টি বিদ্যমান আছে। খাদ্যের মোট ৫টি উপাদান হলো- শর্করা, আমিষ বা প্রোটিন, স্নেহপদার্থ, ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ, খনিজ লবণ এবং পানি। জীব জগতের প্লান্টি বা উদ্ভিদ রাজ্যে খাদ্যের সব উপাদান বিদ্যমান।
শর্করার প্রধান উপাদন- ভাত, গম, আলু ইত্যাদি। আমিষের প্রধান উপাদান প্রাণিজ মাংস হলেও উদ্ভিদ জগতে আমিষ পাওয়া যায় যেমন: ডাল, বাদাম, সয়াবিন, শিমের বিচি ইত্যাদি। আবার সয়াবিন, সরিষা, তিল, বাদাম, সূর্যমুখী এবং ভুট্টার তেল স্নেহপদার্থ। সব ধরনের ভিটামিন আমরা উদ্ভিদ থেকে পেয়ে থাকি। ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন, আয়োডিন, লৌহ, সালফার ইত্যাদি লবণ জাতীয় দ্রব্য খাদ্য মাংস, ডিম, দুধ, সবুজ শাকসবজি এবং ফল খনিজ লবণের প্রধান উৎস।
তাহলে আমরা দেখলাম খাদ্যের সব উপাদান আমরা উদ্ভিদ থেকে পেতে পারি। তাই জীবন ধারনের জন্য বৌদ্ধরা বা যে কোন মানুষ প্রাণি হত্যা না করেও খাদ্য গ্রহণ করতে অসুবিধা হবে না। বরং প্রাণিজ খাদ্যে রোগবালায় বেশি। বর্তমান বিশ্বের বড়বড় ডাক্তারগণ লাল মাংস পরিহার করতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কাজেই বুদ্ধ যথার্থ বলেছেন, জীব হত্যা নয় প্রাণি হত্যা মহাপাপ।
মূল লেখক: শিমুল বড়ুয়া উনন, সম্পাদক, বৌদ্ধবার্তা।