ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু || লেখক
আজ ২১ শে আগষ্ট, ৩ রা ভাদ্র, ভারতে এ নাগপঞ্চমী রূপে দিবসটি পালিত হয়। অর্থাৎ নাগ বা সাপকে পূজা করা হয়। সর্পের সাথে যুক্ত করে বাংলায় মনসাদেবীকে পূজা করা হয় এ সময়ে। নাগপঞ্চমীর এবং এর সত্যিকার ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জানা থাকা প্রয়োজন।
‘নাগ’ অর্থে বর্তমানে সর্প বা সাপ বলে মনে করা হয়। সত্যিকারভাবে নাগ সর্প নয়। নাগ হল প্রাচীন ভারতের বিশেষ এক লোক বিশেষের সম্প্রদায়। তাদেরকে নাগবংশীয় বা নাগবংশের লোক বলা হত। এ নাগবংশীয় লোকেরা ছিলেন ভারতবর্ষের মূল নিবাসী। ইউরেশিয়ান ব্রাহ্মণেরা ভারতে এসে ষড়যন্ত্র পূর্বক তাদেরকে হারিয়ে অসুর নাম দিয়েছে। নাগবংশী রাজা বা যোদ্ধাগণের মধ্যে অনন্ত, বাসুকী, শেষ, পদ্ম, কবল, করকোটিক, অস্তর, শঙ্খপাল, কালিয়া এবং পিঙ্গল ছিলেন প্রসিদ্ধ নাগবীর। ভারতে তাঁদেরই বেশী প্রভাব ছিল এবং নাগবংশীয় লোকেরা তথাগত বুদ্ধের অনুগামী হয়ে বুদ্ধের সদ্ধম্ম প্রসার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
নাগবংশীয় লোকদের সম্রাজ্য ভারত, য়ুনান, মিশর, চীন, জাপান, ইত্যাদি দেশ সমূহেও ছিল। নাগবংশের লোকেরা শ্রাবণ মাসে শেষ পঞ্চমীর দিনে বার্ষিক পঞ্চায়ত করতেন। এ পঞ্চায়ত তাঁদের প্রমুখ নির্বাচনের জন্য অনুষ্ঠিত হত। সেদিন লোকেরা স্নানাদি করে তাঁদের আরাধ্য তথাগত বুদ্ধকে বন্দনা করে খুব ভোরেই তাঁরা গ্রামের সন্থাগারে একত্র হতেন। তাঁদের জীবন-যাপন ছিল একতা, সমতা, ন্যায় এবং ভ্রাতৃত্বের উপর আধারিত। প্রমুখ তথা গণনায়ক নির্বাচনের জন্য প্রত্যাশাীকে কয়েক প্রকারের যোগ্যতা প্রদর্শনের জন্য কয়েকটি প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে হত। যেমন- তলোয়ার যুদ্ধ, মল্লযুদ্ধ, তিরন্দাজী প্রভৃতি। বর্তমানেও নাগপঞ্চমী দিনে কুস্তী, হা-ডু-ডু, যুদ্ধকলা, অশ্বদৌঁড় , তির নিক্ষেপ ইত্যাদি বীরতা, সাহস, কৌশল এবং শক্তির প্রদর্শনকারী খেলা সমূহের আয়োজন করা হয়।
এদিন নাগবংশের জন্য কেবল পরম্পরা, পরাক্রম এবং বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আয়োজন হতনা, বরং এদিন আর্য রাজা পরীক্ষিত বা জন্মেজয় কর্তৃক অসংখ্য নাগ জাতির লোকদেকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল তাও স্মরণ করা হত। তাতে আর্য এবং নাগদের মধ্যে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তখন হতে নাগ জাতির লোকদের ভুলোনোর জন্য তাঁদের ক্রোধ শান্ত করতে নাগদের পূজার প্রথা চালু হয়েছিল। এদিন হল সে নাগদের হত্যার স্মৃতি দিবস। নাগদের নারীরা এদিন নিকটস্থ নদী, পুকুর, জলাশয় প্রৃভৃতিতে গিয়ে স্নান করে বোধিবৃক্ষ, স্তূপ,,চৈত্য, গুহা, বিহার ইত্যাদিতে গিয়ে বুদ্ধের প্রতীক সমূহে পূজা করে ঘর পরিবার এবং সমাজের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করতেন।
শেষ নাগের পুরা নাম ছিল শেষদাত নাগ। তাঁর নামের সমস্ত তথ্য পাওয়া গিয়েছে বৃটিশ যাদুঘরে রক্ষিত প্রাচীন মুদ্রা হতে। শেষদাত নাগ বর্তমান ভারতের মধ্য প্রদেশের বিদিশাকে রাজধানী বানিয়ে ১১০ খৃষ্টপূর্বে নাগবংশের স্থাপনা করেছিলেন। তিনি ২০ বছর রাজত্ব করে খৃষ্টপূর্ব ৯০ অব্দে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই পুত্র ভোগিন ৯০ হতে ৮০ খৃষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।
অতঃপর তাঁর পুত্র চন্দ্রাংশু ৮০ হতে ৫০ খৃষ্টপূর্ব, তাঁর পরে দেব বর্মণ ৫০ হতে ৪০ খৃষ্টপূর্ব এবং সর্বশেষে বঙ্গর ৪০ হতে ৩১ খৃষ্টপূর্ব পর্যন্ত শেষদাত নাগ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের রাজ্য শাসন করেছিলেন। বঙ্গর ছিলেন শেষ নাগের চতুর্থ বংশধর। এভাবে শেষদাত নাগবংশের মোট পাঁচজন রাজা ৮০ বছর পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। এ পাঁচ রাজাদেরকে পঞ্চমুখী নাগরূপে দর্শানো হয়েছে শিল্পকলায়। পঞ্চমুখী নাগ যে বুদ্ধকে ফণা ধরে ঝড় বৃষ্টি হতে রক্ষা করছে বলা হয়েছে, তা হল পঞ্চনাগ বংশীয় রাজাদের বংশধরদের বৌদ্ধ ধম্ম সংরংক্ষণেরই প্রতীক, যা মহারাষ্ট্রের কাহ্নেরী গুহার শিল্পকলায় দেখানো হয়েছে। বুদ্ধের মূর্তির রক্ষক সাতমুখী নাগকেও যে দেখানো হয়েছে, তা পঞ্চমুখী নাগসম্পন্ন মূর্তির চেয়ে ৩৫০ বছর পরে নির্মিত হয়েছে।
নাগপঞ্চমীর উৎসব সত্যিকারভাবে উক্ত পাঁচজন মহাপরাক্রমী নাগবংশী রাজাদের স্মরণে পালন করা হত। তাঁদেরই পাঁচজন বংশধর আবার বুদ্ধের সদ্ধম্মকে ভারতে এবং ভারতের বাহিরে প্রচার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের নাম ছিল অনন্ত, বাসুকী, তক্ষক, করকোটক এবং ঐরাবত। নাগপঞ্চমীর সম্বন্ধ ‘নাগ’ বা সাপের সাথে নয়, বরং তা রয়েছে পাঁচজন পরাক্রমী নাগ রাজাদের সাথে।
তাঁদের গণতান্ত্রিক (Republican) স্বরূপে অনেক স্বতন্ত্র রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। সেগুলির মধ্যে অনন্তনাগের ছিল সবচেয়ে বড় রাজ্য, যা হল বর্তমানে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য। কাশ্মীরে অনন্তনাগ নামে যে শহর রয়েছে, তা সে স্মৃতিই আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁরপরে হলেন বাসুকী নাগরাজা। তাঁর রাজ্য ছিল হিমালয়ের কৈলাশ সরোবরের ক্ষেত্র। তৃতীয় নাগরাজ ছিলেন, তক্ষক, তাঁর স্মরণে এখনো আমরা পাকিস্তানের তক্ষশীলা নাম দেখতে পাই। চতুর্থ নাগরাজা ছিলেন করকোটক এবং পঞ্চম রাজা ছিলেন ঐরাবত, রাবী নদীর আশে-পাশে অর্থাৎ পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বাংশে এরা রাজত্ব করতেন। এ পাঁচজন নাগরাজাদের গণরাজ্যের সীমা একটি সাথে অন্যটির যুক্ত ছিল।
এ সমস্ত এলাকার লোক উক্ত পাঁচজন পরাক্রমী রাজাকে স্মরণ করার জন্য প্রতিবছর তথাকার লোকেরা মহাসমারোহে উৎসবের আয়োজন করত। তা নাগ পঞ্চমী নামে প্রসিদ্ধ ছিল। তাঁদেরকে দেখে অন্যান্য রাজ্যের লোকেরাও এরূপ উৎসব পালন করত। এভাবে নাগ পঞ্চমীর উৎসব সমগ্র দেশে পালনের পরম্পরা চালু হয়। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রান্তির পর ব্রাহ্মণেরা তাঁদের প্রভাব ও কর্তৃত্ব কায়েম রাখতে নাগরাজাদেরকে সর্পে রূপান্তরিত করেছে বলে ভাষা বিজ্ঞানী ও পুরাতত্ব বিশারদ ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ সিং লিখেছেন।
এ সম্পর্কে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক ড. বিলাস খারাত ‘নাগ সংস্কৃতি গ্রন্থকোষ’ পুস্তকের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে-
‘ভারতের প্রাচীন মূল নিবাসীদের বংশ হল নাগবংশ এবং বর্তমান ভারতের সকল বহুজন সমাজের লোকেরা হল নাগবংশীয় বৌদ্ধ। সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা নিজেদের কূল চিহ্নের পূজা করতেন। তাঁদেরকেও নাগবংশী বলা হত। সিন্ধুকালীন পরম্পরা মূলনিবাসী বহুজনেরা এখনও জীবিত রেখেছে। কেননা তা ছিল মূল নিবাসী ভারতীয় পরম্পরা।
নাগবংশী সিন্ধুজনদেরকে ‘অহি’ বলা হত এবং ইরানে তাদেরকে বলা হত ‘অঝি।’ ভারতে মূলনিবাসী নাগবংশীয় শাসকেরা তাঁদের প্রভাব ইরান এবং আরব পর্যন্ত প্রসার করেছিলেন। তক্ষশীলা ছিল নাগদের মুখ্য কেন্দ্র। আরব্য ঐতিহাসিক ফেরিস্তা উল্লেখ করেছেন যে, ইরান এবং আফগানিস্তানের লোকেরা নাগবংশীয় রুস্তুমকে নিজেদের নায়ক বানিয়েছিলেন এবং সেখানে নাগবংশীয়দেরকে ‘ঝোহক’ নাগ বলা হত।
প্রাচীন ভারতে তথাগত বুদ্ধ এবং সম্রাট অসোক নাগবংশের প্রভাব সম্পূর্ণ ভারত তথা ভারতের বাহিরেও প্রসার করেছেন। পালি সাহিত্যে হাতীকে ‘নাগ’ বলা হয়েছে এবং বুদ্ধকেও হাতী বা নাগের প্রতীকরূপে দেখানো হয়েছে। এজন্য বৌদ্ধেরা বুদ্ধকে হাতী বা নাগরূপেও পূজা করে এসেছে। সম্রাট অসোকের দ্বারা পঞ্চ বার্ষিক বৌদ্ধ উৎসবের প্রচলন করা হয়েছিল।
পাঁচটি নিকায় (দীর্ঘ, মধ্যম, সংযুক্ত, অঙ্গুত্তর ও খুদ্দক) অভিজ্ঞদেরকে ‘পঞ্চনৈকায়িক’ বলা হত। এজন্য বুদ্ধের মস্তকে পাঁচ নাগ মস্তক দেখানো হয়েছে, যা হল পঞ্চনৈকায়িক বৌদ্ধের পরিচয়। অনেক বৌদ্ধ প্রচারকদেরকে পঞ্চনাক, পঞ্চনাগ বা পঞ্চিক বলে জানা যেত। মহারাষ্ট্রের পবনী বৌদ্ধ স্তূপের অভিলেখনীতে সম্রাট অসোক ‘পঞ্চনৈকায়িক বৌদ্ধ’ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তা হতে স্পষ্ট হয় যে, মহারাষ্ট্রে পঞ্চনৈকায়িকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। মহারাষ্ট্রের লোকেরা নিজেদেরকে হারিতীপুত্র বলে মনে করেন, কেননা তাঁরা ছিলেন পঞ্চনৈকায়িক।
শ্রাবণ মাস হল বৌদ্ধধম্মে ধম্ম শ্রবণের মাস। শ্রাবণ মাসের প্রথম পাঁচদিন পাঁচ নিকায় গ্রন্থের পাঠ করা হত এবং পঞ্চমদিনে ধম্মগ্রন্থ পাঁচ নিকায়ের পূজা করা হত। ইহাকেই বর্তমানে নাগপঞ্চমী বলা হচ্ছে। সম্রাট অসোক যে পঞ্চবর্ষীয় বৌদ্ধ উৎসব শুরু করেছিলেন, তার পরিবর্তিত স্বরূপ হল বর্তমানের নাগপঞ্চমী। বৌদ্ধ পরম্পরায় পায়সান্নকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এজন্য নাগপঞ্চমীর দিনে নাগদেরকে ( বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণীগণ) পায়সান্ন দান করা হত। বর্তমানে ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদেরকে পায়সান্ন দানের পরিবর্তে সর্পকে (নাগ) দুধ পান করানো হয়।
বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকেই বৌদ্ধ সাহিত্যে নাগবংশী বলা হয়েছে। এজন্য মহারাষ্ট্রের লোক এখনও নিজেদের নামের সাথে নাক শব্দের ব্যবহার করে থাকে। মহারাষ্ট্রে পঞ্চনিকায়ের প্রভাব অধিক থাকার কারণে সেখানে পঞ্চনাগ নাম হতে ‘নাগপুর’ নাম হয়েছে এবং নাগ পঞ্চমী উৎসবও ব্যাপকভাবে পালন করা হয়েছে।
অনন্ত, বাসুকী, শেষদাতের মত রাজাগণ উত্তর ভারতে রাজত্ব করে গিয়েছেন। এজন্য তাঁদের স্মরণে উত্তর ভারতের লেকেরা নাগপঞ্চমী উৎসব পালন করতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু তা শুরু হয়েছিল মহারাষ্ট্র হতে। এখানে আলেচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, মহারাষ্ট্রের লোক নাগরাজাদের স্মরণে উৎসব পালন করেনি, বরং সম্রাট অসোকের পঞ্চবার্ষিক বৌদ্ধ উৎসবের স্মরণে এবং তারা নিজেরা পঞ্চনৈকায়িক বৌদ্ধ হওয়ার কারণে নাগপঞ্চমী উৎসব পালন করেছে।
উপরোক্ত আলোচনায় ইতিহাসের কিছু বৈসাদৃশ্য থাকলেও এক জায়গায় স্পষ্ট হয়েছে যে, নাগপঞ্চমী মানে সাপের পূজা নয়, তাহল বৌদ্ধ উৎসব, যা ব্রাহ্মণীকরণ করে ধূর্ততার সাথে বুদ্ধ ও বৌদ্ধদেরকে সাপের সঙ্গে যুক্ত করেছে।