রোহিঙ্গা ক্যাম্পে: কোরিয়ান সিওন জেন বৌদ্ধদের মাস্টার শ্রদ্ধেয় পমনিউন সুনিম পৃথিবীর বৃহত্তম শরণার্থী শিবির কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১ লক্ষ রোহিঙ্গা পরিবারের মধ্যে গ্যাসের চুলা বিতরণ করতে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ (শুক্রবার) তিনি বাংলাদেশে আশ্রয়রত মিয়ানমার কর্তৃক নিপিড়নের শিকার জনগুষ্টি রোহিঙ্গাদের দেখতে ও গ্যাসের চুলা বিতরণ পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরে দেখেন। তার প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা JTS এর মাধ্যমে এই চুলা বিতরণ করা হয়।
শ্রদ্ধেয় পমনিউন সুনিম এর সাথে Join Together Society (JTS) এর উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তা সফর সঙ্গী হিসেবে ক্যাম্পগুলোতে ভিজিট করেন।
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে গ্যাসের চুলা হস্তান্তর অনুষ্ঠান ও পরিদর্শনকালে সুনিম জেটিএস টিমের নেতৃত্ব দেন, যার মধ্যে জেটিএস ইন্ডিয়ার সেক্রেটারি-জেনারেল বোকওয়াং, কিম ইউন-হি এবং লি হাই-ওকে সাথে ছিলেন।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সাল থেকে মাস্টার সুনিমের JTS এর পক্ষ থেকে UNHCR, IOM, WFP সহ অনেক আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার মাধ্যমে এই গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের কাজ করে আসছে। ধারাবাহিকভাবে এই বছরও শ্রদ্ধেয় পমনিউন সুনিম এক লক্ষ গ্যাসের চুলা যুক্ত করলেন।
হস্তান্তর অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয় পমনিউন সুনিম বলেন, “উদ্ধাস্তুদের আগমনের পর এই এলাকাটি একটি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল। কারণ সে সময় উদ্ধাস্তুদের ঘর তৈরী, রান্না কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক গাছ কাটতে হয়েছিল। জ্বালানি সংগ্রহ করার সময় মহিলা এবং শিশুদের প্রায়ই লাঞ্ছিত বা পাচার করা হতো। বনাঞ্চল এবং রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য, জেটিএস জাতিসংঘ সংস্থার সহযোগিতায় গ্যাসের চুলা প্রদান শুরু করে। এই প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে চার বছর কেটে গেছে এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বন ইতিমধ্যে ঘন এবং সবুজ হয়ে উঠছে।”
ক্যাম্পে জেটিএস প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানান আইওএম বাংলাদেশের ডেপুটি চিফ অব মিশন নিহান এরদোজেন। তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনকে সমর্থন করার জন্য JTS-এর প্রচেষ্টার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানান, অনুদান দেওয়া গ্যাসের চুলার সরাসরি ফলাফল হিসাবে গ্রামের অবস্থার উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি হয়েছে বলে উল্লেখ করে।
তিনি উল্লেখ করে বলেন, “এই গ্যাসের চুলার কারণে, গ্রামে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার সমস্যাগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। এই নতুন স্টোভগুলির সাহায্যে আমরা প্রায় ৪৬০০০০ লোককে সরাসরি জ্বালানি সহায়তা দিতে সক্ষম হব। আপনার আগমনকে ৪৬০০০০ জন মানুষের পক্ষ থেকে আমি স্বাগত জানাচ্ছি। আমি ইচ্ছা ছিল সমস্ত ৪৬০০০০ জন লোককে এখানে আনতে যাতে তারা আপনাকে বলতে পারে যে তারা কতটা কৃতজ্ঞ! কিন্তু এতো লোকের স্থান দিতে কষ্ট হবে ভেবে তাদের আনা সম্ভব হয়নি। তাদের পক্ষ থেকে, আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আপনার অসমান্য উপহারে আমরা সত্যিই, সত্যিই খুব খুশি ও ধন্য!”
শ্রদ্ধেয় পমনিউন ১৯৯৩ সালে সর্ব প্রথম জেটিএস প্রতিষ্ঠা করেন। সুনিম বৌদ্ধধর্মের শ্রেষ্টবাণী ”সকল প্রাণি সুখি হোক” মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, নিজের জীবনকে সমৃদ্ধ করার সর্বোত্তম উপায় হলো, সকলের জন্য সমবেদনা এবং সাহায্য করা। JTS এর সদর দফতর দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে তবে ভারত এবং ফিলিপাইনে তাদের অন্যতম প্রধান শাখা অফিস আছে। বর্তমানে জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে JTS এর প্রোগ্রাম অফিস পরিচালনা করেছে তারা। ত্রাণ সংস্থাটি জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ECOSOC) বিশেষ পরামর্শকের মর্যাদা অর্জন করেছে।
JTS বৌদ্ধ সুনিমের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলেও ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল জনগোষ্টির জন্য সমানভাবে কাজ করে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের জন্য আশা, ক্ষমতায়ন এবং স্বনির্ভরতা আনার জন্য JTS নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। “এশীয় জনগণের প্রচেষ্টায় এশিয়ার দারিদ্র্য ও মানবেতর সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে” মানবিক বিপর্যয়ের শিকার দেশগুলিতে JTS ত্রাণ কাজ করে। ইতিমধ্যেই কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, উত্তর কোরিয়ায়, ফিলিপাইন এবং শ্রীলঙ্কায় অনেক মানবিক প্রকল্প সম্পন্ন করেছে JTS।
২০১৭ সালের অক্টোবরে, জেটিএস কোরিয়া বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ১৫ টন চাল এবং ৭০০ টি মশারি সরবরাহ করেছিল। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আরও ৩০ টন চাল এবং ২,০০০ কম্বল বিতরণ করেছিল। এই পরিদর্শনের সময়ই WFP, জাতিসংঘের সংস্থা যা ত্রাণ শিবিরগুলোর তদারকি করে JTC-ই সর্বপ্রথম গ্যাসের চুলা সরবরাহ করার প্রস্তাব করেছিল।
২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরগুলোতে JTS ২০০০০০ গ্যাস স্টোভ অনুদান দিয়েছে। যার ফলে প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ সরাসরি উপকৃত হয়েছে এর থেকে। এই প্রকল্পটি অপুষ্টি কমাতে সাহায্য করেছে, স্থানীয় পরিবেশকে পুনরুদ্ধার করেছে এবং নারী ও শিশুদের জীবনে কাজের চাপ ও বিপদ কমিয়েছে।
শ্রদ্ধেয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী পমনিউন সুনিম আন্তর্জাতিক মানবিক কাজ, পরিবেশগত ও সামাজিক সক্রিয়তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখে। বিশ্ব শান্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও সদ্ভাব গড়ে তোলার জন্য তিনি অক্লান্ত প্রচেষ্টার চালিয়ে যাচ্ছে। তার এহেন সুকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২০ সালের অক্টোবরে, জাপানের নিওয়ানো পিস ফাউন্ডেশন শ্রদ্ধেয় সুনিমকে ৩৭তম নিওয়ানো শান্তি পুরস্কার প্রদান করে।