থাইল্যান্ডে বিবাহ অনুষ্ঠানের বৌদ্ধ নিয়ম

থাইল্যান্ড একটি বৌদ্ধ প্রধান দেশ। উইকিপডিয়া তথ্যমতে বর্তমানে থাইল্যান্ডের ৬৯,১২০,০০০ জন জনসংখ্যার মধ্যে ৬৪,৪২০,০০০ জন বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। থাইল্যান্ডে সাধারনত দুই ধরণের বিবাহ হয়। একটি সনাতন বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অপরটি আইনী বিবাহ নিবন্ধন করার মাধ্যমে। অনুষ্ঠানিক বিয়ে হলেও নিবন্ধনের মাধ্যমে আইনগত দিকগুলির যথাযত যত্ন নেয়।

একটি সনাতন বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতির কয়েকটি দিক তুলে ধরার চেষ্টা করব।

বিবাহ প্রস্তুতি

থাই ঐতিয্যানুসারে বিয়ের ব্যাপারে বর ও কনে উভয়ের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। থাইল্যান্ডের একটি খুব সুন্দর প্রথা প্রচলিত আছে। বিয়ের আগে বরের অন্যতম ভাল বন্ধুকে দিয়ে কনের পিতার কাছে জানতে চাওয়া হয়। বরের বন্ধুর মাধ্যমে কনের পিতাকে বলা হয়, এই বিয়েতে কনের নিজস্ব মতামত আছে কিনা তা যেন কনেকে জিজ্ঞাসা করা হয়। তার মানে হলো বিয়ের আগে বর এবং কনে কেউই সরাসরি আনুষ্ঠানিক বিয়ের প্রস্তাবের সাথে জড়িত নয়!

উভয় পরিবার একমতে পৌছলে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য একটি সুন্দর তারিখ নিয়ে আলোচনা করা হয়। যেখানে একজন জ্যোতিষিকে আমন্ত্রণ করে দিনটির ভাল মন্দ বিচার করা হয়। তারা ঐ দিন আইনী নিবন্ধকরণ কাজটিও শেষ করে নেয়। তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়।

উপহার ও যৌতক

বিয়েতে বরকে দুই ধরনের উপহার দিতে হয়। একটি হল বিয়ের আগে বাগদান অনুষ্ঠানে কনেকে সোনার গহনা উপহার দেওয়া।

বাগদান বা এনগেইজম্যান্টকে থাই ভাষায় থংমুন বলে। থংমুনে, একজন সম্ভাব্য বর তার বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনদের উপস্থিতিতে সম্ভাব্য কনেকে স্বর্ণ উপহার দেয়। ডায়মন্ডের অংটির পরিবর্তে থাইরা সাধারণত ৯৬% (২৪ ক্যারেট) খাটি সোনার গহনা দেয়। সোনার গহনার ওজন সবসময় একটি বিজোড় সংখ্যা পরিমান নির্ধারণ করা হয়।

দ্বিতীয়টি হ’ল যৌতুকের উপহার যেটি বর বিয়ের দিন কনের পিতামাতাকে দিয়ে থাকেন। থাইল্যান্ডের বিবাহ ঐতিহ্যগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হল যৌতুক প্রথা। ছেলে পক্ষ কনে পক্ষের পরিবারকে যৌতুক দিয়ে থাকে। এই প্রথাকে থাই ভাষায় “সিন সোড” বলে। থাই শব্দ “সিন” অর্থ ধনী আর “সোড” অর্থ আইন। কনের পরিবারের সাথে আলোচনা করে যৌতুক ধার্য্য করা হয়।

যদিও আধুনিক সমাজে যৌতুককে একটি ঘৃণ্য প্রথা হিসেবে দেখা হয় তবুও থাই সংস্করণটি আসলেই মনোমুগ্ধকর ও ভিন্ন। থাইরা এটিকে বর পক্ষের জন্য একটি বড় সুযোগ বলে মনে করে। এটার মাধ্যমে বর কনের মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার সুযোগ পায়।  এছাড়াও বর তার কাঙ্খিত কনের বরণ পোষণ করার জন্য সক্ষম কিনা তাও এই প্রথার মাধ্যমে বুঝা যায়।

যৌতুক ধার্য্য অনুষ্ঠানে ছেলে পক্ষ থেকে সাধারনত ছেলের সব চেয়ে ভাল বন্ধুটি তার হয়ে উকালতি করে। অনুষ্ঠানে আলোচনার মাধ্যমে ধার্য্য করা হয় বর কত টাকা যৌতুক দিতে পারবে।

সাধারনত একজন মধ্যম শিক্ষিত মেয়ের জন্য ১০০,০০০ থাই বাথ যৌতুক হিসেবে গুনতে হয়। তবে কোন তালাক প্রাপ্ত মহিলা বা আগের স্বামীর সন্তান সহ মহিলার পরবর্তী বিয়ের জন্য তাকে কোন যৌতক দেওয়া হয় না।

আধুনিক থাইল্যান্ডে এখনো অনেকে যেমন এই প্রথাকে বাতিল করতে চায় না তেমনি অপ্রয়োজনীয় কোন অর্থ তাদের মেয়ের জন্য নিতে রাজি হয় না। তারা ঐতিয্য রক্ষার জন্য প্রথমে যৌথক গ্রহণ করে এবং পরে তা নব বিবাহিত দম্পতিকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেয় অথবা তাদের বিবাহ খরচ হিসেবে খরচ করে।

থাই বৌদ্ধরা বিশ্বাস করে যে বিবাহ একটি স্বর্গ থেকে আসা সম্পর্ক। তাই বেশির ভাগ থাই জনগন বিবাহে প্রাপ্ত অর্থ বিহারে দান করে দেয়। বিবাহের দিন ভিক্ষুগণকে ফাং করার মাধ্যমে একটি আশির্বাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। সেখানে প্রাপ্ত অর্থ ভিক্ষুর হাতে দান করে দেয়। সাধারনত এই আশির্বাদ অনুষ্ঠানেও একটি বিজোড় সংখ্যক বৌদ্ধ ভিক্ষু ফাং করে। সংখ্যাটি ৩ জন, ৫ জন, ৭ জন এবং বেশির ভাগ সময় ৯ জন হয়। কিন্তু ৯ জনের বেশি কখনই হয় না।

পূর্বপুরুষদের স্মরণে পূণ্যদানঃ

থাই বিবাহের ঐতিহ্যগুলির মধ্যে একটি হল বর কনের পূর্বপুরুষদের পূণ্যদান ও স্মরণ করার জন্য সংঘদান করা বা প্রাণি অবমুক্ত করণ।

বিয়ের আগের দিন সকালে বর-কনে তাদের পূর্বপুরুষদের সম্মান, স্মরণ ও পূণ্য দান করার জন্য একটি সংঘদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ভিক্ষুরা সংঘদানে অংশ নিয়ে আশীর্বাদ করেন এবং পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে পূণ্যদান করেন।

পোষাকঃ

থাই বিবাহ পোষাক সাধারনত ছয় ধরনের হয়। ছয় ধরনের পোষাক থেকে যে কোন একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাক বিয়ের জন্য পছন্দ করে। বর্তমানে কোন কোন দম্পতি পাশ্চাত্য ধাঁচের সাদা পোশাক এবং স্যুট পরতে পছন্দ করেন।  তবে বেশিরভাগ দম্পতি ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন।

থাইল্যান্ডে বিবাহ অনুষ্ঠানের বৌদ্ধ নিয়ম
ছবিঃ সংগৃহীত

বরের করণীয়

পূর্বপুরুষদের পূণ্যদান দেওয়ার পর বরকে কনে বিয়ে করার অনুমতি দিলেই বরের কাজ শেষ হয়ে যায় না। বিয়ের দিন বর, তার পরিবার এবং বন্ধুবান্ধব সবাইকে আধা কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে গান বাজনা বাজিয়ে কনের বাড়ি পৌঁছতে হয়। কনের বাড়ি পৌঁছার পর বরকে অনেক গুলো গেইট পার হয়ে বিবাহ মঞ্চে যেতে হয়। প্রতিটি গেইটে টাকা পরিশোধ করেই বর বিবাহ মঞ্চে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে।

সবগুলো গেইট পার হবার পর বর-কনেকে এক সাথে বসানো হয়। এই সময় বর কনের বাবা-মার কাছে যৌতুকের  টাকা প্রদান করেন। তবে বর্তমানে যৌতুক বিবাহের পর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রদান করা হয়।

বিবাহ অনুষ্ঠান

বিবাহের প্রধান আকর্ষণ অনুষ্ঠিত হয় বিকালে যাকে থাই ভাষায় রড নাম সং বলে। নির্দিষ্ট স্থানে বিবাহ কার্য শুরু হয়। বিবাহ মঞ্চে নব দম্পতি হাত জোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে একে অপরের পাশে বসেন বা হাঁটেন।

তারপরে একজন প্রবীণ ব্যক্তি এসে তাদের উভয়ের মাথায় একটি মং কল রাখবেন। এটি সাদা তুলা দিয়ে তৈরি। এর মানে হলো তাদের এখন একত্রে জুড়ে দেওয়া হল।

এরপর শঙ্খ খোলের পানি ঢালার পালা। মুরব্বিরা এসে শঙ্খ খোল থেকে পবিত্র পানি ঢেলে বর-কনের হাত ভিজিয়ে দেন এবং উপদেশ দেন।

অনেকে আবার মঙ্গল সুতা পরিধান করতে পছন্দ করেন। বয়োজ্যেষ্ঠরা এসে পবিত্র সূত্রপাঠ করা সাদা মঙ্গল সুতা পরিধান করিয়ে দিতে দিতে উপদেশ প্রদান করেন আর তাদের দাম্পত্য সুখ কামনা করেন।

যদি কেউ পবিত্র সুতা পরিয়ে দিতে চায় সেক্ষেত্রে সবাই সুতা পরিয়ে দিতে পারে। বর-কনে এই পবিত্র মঙ্গলময় সুতা ৩ দিন পযর্ন্ত হাতে পরিধান করে রাখে।

রাতের খাবারঃ

সন্ধ্যার দিকে সবচেয়ে বড় খাবারের আয়োজন করা হয় যেখানে অনেক মানুষে আগমন হয়। সাধারনত সন্ধ্যার খাবারের আয়োজনে ১০০ থেকে ৩০০ জন অতিথিকে খাওনো হয়। তবে এই অতিথি গণনা করা কখই সম্ভব নয়। এখানেই পশ্চিমাদের সাথে থাইদের পার্থক্য। পশ্চিমারা সাধারনত তেমন অতিথি বা আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করেনা যেখানে থাইরা তাদের অবহেলিত অ-আমন্ত্রিত অতিথিদেরও খাবার পরিবেশন করে থাকে।

বিবাহ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানঃ

বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে পরিবার ও বন্ধুরা দাঁড়িয়ে মঙ্গলময় শব্দ উচ্চারণ করা হয়। লটারি, গান বাজনা, খেলাধূলা ইত্যাদি থাকে এই অনুষ্ঠানে।

এরপর তাদের ঘরে বিছানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মা-বাবা তাদের সুখ, সমৃদ্ধি, সম্প্রীতি, প্রেম, আরাম এবং দীর্ঘজীবনের প্রতীক দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। সেখানেও তাদের সুপরামর্শ ও উপদেশ দেওয়া হয়। এটি থাইল্যান্ডের একটি ঐতিয্য হলেও বর্তমানে তা আস্তে আস্তে তা হারিয়ে যাচ্ছে।

জাতী, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি নির্বিশেষে থাইদের মধ্যে একটি বিষয় মিল রয়েছে। থাইরা বিবাহের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে চায়। এখানে প্রতিবছর অনেক বিদেশি নাগরিক বিবাহ করার জন্য চলে আসে। এমন কি থাইল্যান্ডে বিবাহ ভিসা নামে আলাদা ভিসা আছে। আপনি চাইলে বিবাহ ভিসা নিয়ে থাইল্যান্ডে বিবাহ ও বসবাস করতে পারবেন। বিবাহ যোগ্য ও মনোনীত নর-নারীরা থাই্ল্যান্ডের সাদা বলির সমুদ্র সৈকত যেখানে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বাতাস এবং প্রচুর সূর্যালোক থাকে সেটাকে অনেক পছন্দ করে। প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সমগ্র ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত  থেকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য থাইল্যান্ডের স্বর্গতুল্য দ্বীপ কোহ সাউমিতে চলে আসে।

শেয়ার করে সবাইকে পড়ার সুযোগ দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!