বর্ষাবাসব্রত
বর্ষাবাস বৌদ্ধদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার বা অনুষ্ঠান। ভগবান বুদ্ধ তাঁর সংঘ প্রতিষ্ঠার পর সুষ্ঠভাবে সেই সংঘ পরিচালনার নিমিত্তে বিভিন্ন নিয়ম-কানুন প্রবর্তন করেন। বর্ষাবাস বুদ্ধ প্রবর্তিত বিধি-বিধানেরই অংশ।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাস ভিক্ষুরা বর্ষাবাব্রত পালন করেন। এ সময় তারা বিহারে অবস্থান করে ধর্মালোচনা, ধর্মশ্রবণ, ধর্ম-বিনয় ও ধ্যান-সমাধি চর্চা এবং অধ্যয়ন করে সময় অতিবাহিত করার চেষ্টা করেন। বর্ষাকালে বিহারে বাস করে এই ব্রত বা অধিষ্ঠান পালন করা হয় বলে এটিকে বর্ষাবাব্ৰত বলে। বর্ষাব্রত পালনের মাধ্যমে ভিক্ষুদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হয়।
বর্ষাবাসব্রতের পটভূমি
ভিক্ষুসংঘ গঠন করার পর বুদ্ধ সর্বপ্রাণির কল্যাণের জন্য তাঁর ধর্মবাণী দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে ভিক্ষুদের নির্দেশ দেন। বুদ্ধের নির্দেশে ভিক্ষুগণ পায়ে হেঁটে পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে বিভিন্ন লোকালয়ে গিয়ে ধর্ম প্রচার ও দেশনা করতেন। কিন্তু বর্ষাকালে ভিক্ষুরা বিভিন্ন রকম অসুবিধা ভোগ করতেন। তাঁরা কর্দমাক্ত পথে যাতায়াতের সময় প্রচুর কষ্ট ভোগ করতেন। পোকা-মাকড় এবং সাপের দংশনে অনেকের প্রাণ সংহার হতো।
ঝড়-বৃষ্টিতে ভেজার কারণে নানারকম রোগ হতো। ভেজা কাপড় পরে থাকতে হতো। কারণ তখনো দায়ক-দায়িকাদের নিকট থেকে চীবর গ্রহণের নিয়ম প্রচলন হয়নি। ফলে ভিক্ষুসংঘ নানারকম জটিল রোগে আক্রান্ত হতেন। তা ছাড়া বর্ষাকালে ভিক্ষুদের যাতায়াতে অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেক সবুজ তৃণ এবং ক্ষুদ্র প্রাণী ভিক্ষুদের পদদলিত হতো।
বুদ্ধ রাজগৃহের বেণুবন বিহারে অবস্থানকালে এসব বিষয় জ্ঞাত হন। তখন তিনি বর্ষা ঋতুর তিন মাস অর্থাৎ আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথি থেকে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত বিহারে বসবাস করে ধর্মালোচনা, ধর্ম শ্রবণ, ধ্যান-সমাধি এবং বিদ্যাচর্চা করে অতিবাহিত করার জন্য ভিক্ষুদের নির্দেশ দেন। তখন থেকে বর্ষাবাস উদ্যাপন শুরু হয়।
বর্ষাবাব্রতকালে ভিক্ষুসংঘ কায়িক, বাচনিক এবং মানসিক পরিশুদ্ধিতা অর্জন করেন। তাই বর্ষাব্রতকে আত্মশুদ্ধির অধিষ্ঠান বলা হয়।
বুদ্ধ বলেছেন, যে স্থানে উপযুক্ত দায়ক-দায়িকা থাকেন এবং যে স্থান ধ্যান-সাধনার অন্তরায় নয় সেখানে। ভিক্ষুদের বর্ষাবাশ্রত পালন করা উচিত।
বুদ্ধের সময়কালে প্রাচীন ভারতের উরুবেলা, রাজগৃহ, নালন্দা, পাটলিপুত্র, শ্রাবস্তী, সাকেত, পাবা প্রভৃতি বর্ষাবাসব্রতের জন্য উপযুক্ত স্থান ছিল।
বর্ষাবাসব্রতের বিধান
তিন মাস যে কোনো একটি বিহারে অবস্থান করে ভিক্ষুদের এই বর্ষাবাব্ৰত উদযাপন করতে হয়। তখন তাঁরা অধ্যয়ন, ধ্যান-সাধনা ও ধর্মচর্চা করে দিন অতিবাহিত করেন। কোনো জরুরি কাজে নিজ বিহার থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে সন্ধ্যার আগেই বর্ষাবাস উদ্যাপনকারী ভিক্ষুকে নিজ বিহারে ফিরে আসতে হয়। তবে কিছু কারণে বর্ষাবাসের সময় নিজ বিহার ছাড়াও অন্যত্র রাত্রি যাপন করা যায়। কারণগুলো হলো:
- ১. অসুস্থ ভিক্ষু-ভিক্ষুণী, শ্রমণ এবং রুগ্ণ দায়ক-দায়িকা দেখার জন্য।
- ২. বুদ্ধশাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীকে উপদেশ দেবার জন্য।
- ৩. কোনো উপাসক বা উপাসিকা সংঘের উদ্দেশ্যে বিহার নির্মাণ করলে তাতে সহযোগিতা ও উৎসর্গ অনুষ্ঠানে যোগদান করার জন্য।
- ৪. বর্ষাবাব্রতধারী ভিক্ষু বা ভিক্ষুণী, শ্রমণ বা শ্ৰমণী অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য।
- ৫. কোথাও মিথ্যাদৃষ্টি বা সন্দেহ উপস্থিত হলে বা কেউ মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে তা দূর করার জন্য।
- ৬. পরিবাস কর্ম, আহবান কর্ম, প্রব্রজ্যা দান প্রভৃতি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের জন্য।
ওপরে বর্ণিত কারণে বর্ষাব্রতের সময় বাইরে অবস্থান করা গেলেও এক সপ্তাহের মধ্যে বর্ষাবাস পালনকারী ভিক্ষুকে বিহারে ফিরে আসতে হয়।
তবে বন্য জন্তু, সাপ, চোর-ডাকাতের উপদ্রব, বিহারের দায়ক-দায়িকারা বিবাদগ্রস্ত এবং তর্কপ্রিয় হলে, আগুন, পানি, বন্যা, ঝড় প্রভৃতি কারণে বর্ষাবাসের স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হলে বর্ষাবাসের স্থান পরিবর্তন করা যাবে। এতে ভিক্ষুদের বর্ষাবাব্রত লঙ্গন হয় না।
বর্ষাবাসব্রতে ভিক্ষুদের করণীয়
বর্ষাবাস ভিক্ষুদের অবশ্য পালনীয় একটি কর্ম। এ সময় ভিক্ষুদের অনেক করণীয় কর্ম থাকে। তা নিম্নে তুলে ধরা হলো:
- ১। বর্ষাবাব্রত পালনকালে ভিক্ষুদের শাস্ত্র অধ্যয়ন, ধ্যান-সমাধি চর্চা, ধর্মালোচনা এবং ধর্ম শ্রবণ করে বিশুদ্ধ জীবনযাপন করতে হয়।
- ২। বর্ষাবাসব্ৰতকালে প্রতি পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও অষ্টমী তিথিতে ভিক্ষুদের পাতিমোক্খ আবৃত্তি করতে হয়।
- ৩। বর্ষাবাসব্রতকালে ভিক্ষুগণকে ছোট-বড় ভেদাভেদ ভুলে নিজের দোষত্রুটি স্বীকার করতে হয়। এজন্য জ্ঞাত বা অজ্ঞাতভাবে কৃত দোষের জন্য তারা পরস্পরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কনিষ্ঠ ভিক্ষু বয়োজ্যষ্ঠ ভিক্ষুর কাছে এবং বয়োজ্যষ্ঠ ভিক্ষু কনিষ্ঠ ভিক্ষুর কাছে দোষের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ফলে অহংকার দূরীভূত হয়। পারস্পরিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়।
- ৪। বিহারাঙ্গণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়।
বর্ষাবাসব্রতে গৃহীদের করণীয়
বর্ষাবাসব্রত ভিক্ষুদের পালনীয় কর্ম হলেও এ সময় গৃহীদেরও অনেক করণীয় রয়েছে। বর্ষাবাব্রতধারী ভিক্ষুদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দান করা গৃহীদের কর্তব্য। ভিক্ষুদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব একত্রে চতুর্প্রত্যয় বলা হয়।
বর্ষাবাসব্রতের সময় গৃহীরা ভিক্ষুদের চতুর্পত্যয় দান করেন। চতুর্থত্যয় হলো: অন্ন, বস্ত্র (চীবর), বাসস্থান ও চিকিৎসা।
গৃহীরা নিজ নিজ গ্রামের বিহারে বর্ষাবাস উদ্যাপনের জন্য ভিক্ষুদের আমন্ত্রণ জানান। ভিক্ষু সম্মতি জ্ঞাপন করলে নির্দিষ্ট তিথিতে বর্ষাবাসব্রত শুরু হয়।
বর্ষাবাসব্রতের সময় প্রতিটি পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও অষ্টমী তিথিতে গৃহী বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে উপোসথ গ্রহণ করেন। ভিক্ষুদের কাছ থেকে ধর্মকথা শ্রবণ করেন। এ সময় ধর্মসভারও আয়োজন করা হয়। পণ্ডিত ভিক্ষু এবং পন্ডিত ব্যক্তিরা ধর্মালোচনা করেন। গৃহীরা ধর্মসভায় যোগদান করে ধর্মালোচনা শ্রবণ করেন। ধ্যান-সমাধি চর্চা করেন। প্রাণী হত্যা হতে বিরত থাকার অভ্যাস গড়ে তোলেন। কুশলকর্ম সম্পাদন করেন। এভাবে গৃহীরা বর্ষাবাতের সময় ধর্মসম্মত জীবনযাপন করে পরিশুদ্ধি লাভ করেন।
উপোসথ
উপোসথ ভিক্ষু এবং গৃহী উভয়ের পালনীয় একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। উপোসথের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। বৌদ্ধ পূর্ণিমা, অমাবস্যা এবং অষ্টমী তিথিতে উপোসথ পালন করেন। ধর্মময় উৎকৃষ্ট জীবন গঠনের জন্য বুদ্ধ উপোসথের প্রবর্তন করেছিলেন। উপোসথ পালনে ধর্মানুভূতি জাগ্রত হয়। কায়-মন-বাক্য এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয় সংযত হয়। তাই সকলের উপোসথ পালন করা উচিত।
উপোসথের পটভূমি
একসময় বুদ্ধ রাজগৃহের গৃধ্রকূট পর্বতে অবস্থান করছিলেন। সে সময় অন্যান্য তীর্থিক সম্প্রদায়ের পরিব্রাজকগণ চতুর্দশী, পঞ্চদশী এবং অষ্টমী তিথিতে সমবেত হয়ে ধর্মালোচনা করতেন।
জনসাধারণ তাঁদের কাছে ধর্ম শ্রবণের জন্য উপস্থিত হতেন। তাদের শ্রদ্ধা ও সৎকার করতেন। ফলে তীর্থিক পরিব্রাজকগণ জনগণকে তাদের পক্ষভুক্ত করে নিতেন।
একদিন মগধরাজ বিম্বিসার নির্জনে ধ্যানাবিষ্ট থাকার সময় তাঁর মনে এরূপ চিন্তা উদিত হয়: ‘এখন অন্যান্য তীর্থিক পরিব্রাজকগণ চতুর্দশী, পঞ্চদশী এবং অষ্টমী তিথিতে সমবেত হয়ে ধর্মালোচনা করছেন। জনসাধারণ ধর্ম শ্রবণের নিমিত্ত তাঁদের নিকট উপস্থিত হচ্ছেন। তাঁদের শ্রদ্ধা ও সৎকার করছেন। ভিক্ষুগণও চতুর্দশী, পঞ্চদশী এবং অষ্টমী তিথিতে সমবেত হলে ভালো হয়।
এভাবে তিনি ভিক্ষুদের ধর্ম-বিনয় পালনের সময় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করার কথা ভাবলেন। অতঃপর তিনি বুদ্ধের নিকট উপস্থিত হয়ে অভিবাদনপূর্বক বুদ্ধকে বিষয়টি উপস্থাপন করেন।
বুদ্ধ মগধরাজ বিম্বিসারের আবেদন গভীরভাবে উপলব্ধি করেন এবং তাঁকে ধর্মদেশনা করেন। ধর্মবাণী শ্রবণ করে রাজা বিম্বিসার মৈত্রীচিত্তে প্রাসাদে গমন করেন। তারপর ভগবান বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে আহ্বান করে চতুর্দশী, পঞ্চদশী এবং অষ্টমী তিথিতে সমবেত হয়ে উপোসথ পালন, উপপাসথে ধর্মালোচনা ও পাতিমো আবৃত্তির নির্দেশ দেন। তখন থেকে উপোসথের প্রচলন শুরু হয়।
বুদ্ধ অত্যন্ত পরিমিত আহার করতেন। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে তাঁর কখনো আতিশয্য ছিল না। তিনি ভিক্ষুসংঘকেও পরিমিত আহারের উপদেশ দিতেন।
সূত্রপিটকের মজ্ঝিম নিকায়ের ‘কীটাগিরি সূত্রে দেখা যায়– বুদ্ধ তাঁর শিষ্য প্রশিষ্যদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, “হে ভিক্ষুগণ! আমি রাতের আহার ছেড়ে দিয়েছি। তাতে আমার শরীরের অসুখ ও জড়তা কমে গেছে। শরীরের কর্ম শক্তি বেড়েছে। চিত্তে প্রশান্তভাব এসেছে। হে ভিক্ষুগণ! তোমরাও এভাবে চলবে। তোমরা যদি রাতের আহার ছেড়ে দাও তাহলে তোমাদের শরীরে রোগ সমস্যা কম হবে। শরীরের জড়তা কমে যাবে। সুস্থ থাকবে এবং তোমাদের চিত্তে স্থিরতা আসবে।
সেই সময় থেকে ভিক্ষুদের মধ্যে এক বেলা আহার করার নিয়ম প্রবর্তন হয়। তা গ্রহণ করতে হয় মধ্যাহ্নের মধ্যে। দুপুর বারোটার আগে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এ নিয়ম নিয়ত পালন করেন। ভিক্ষুদের অনুসরণ করে গৃহীরাও উপপাসথ তিথিতে এ নিয়ম অনুশীলন করেন। উপোসথ দিনে গৃহীরা দুপুর বারোটার মধ্যে আহার শেষ করেন এবং পরদিন সূর্য উদয় না হওয়া পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করেন না।
উপোসথ ও উপবাসের মধ্যে পার্থক্য
‘উপোসথ’ শব্দটি ‘উপবাস’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। বৌদ্ধরা পূর্ণিমা, অমাবস্যা এবং অষ্টমী তিথির উপপাসথে উপবাসব্রত পালন করেন। প্রতিদিন তিনবেলা আহার মানুষের নিত্য নৈমিত্তিক অভ্যাস। মাঝে মাঝে উপবাস করে শরীরে খাদ্যদ্রব্যের উপযোগিতা অনুভব করা যায়। এ ছাড়া এর মাধ্যমে দরিদ্র অভুক্ত মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করা যায়। তাই অনেকের কাছে উপবাস উপোসথের প্রধান অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়।
উপোসথতে বৌদ্ধরা উপবাস পালন করলেও বৌদ্ধধর্মে উপোসথ অর্থ কেবল উপবাস বা খাদ্য-দ্রব্য গ্রহণ হতে বিরত থাকা বোঝায় না। উপোসথের সাথে ধর্মানুশীলন, শীল পালন, ধ্যান-সমাধি চর্চা ও সংযত জীবনযাপনের বিষয়টিও ঘনিষ্টভাবে জড়িত।
উপোসথ পালনকারীদের বিনয় বিধান অনুসারে কিছু নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদনে ব্রতী হতে হয়। কিন্তু কেবল উপবাসের ক্ষেত্রে এ বিধি পালনীয় নয়। যেমন, উপোসথ দিবসে বিহারে ভিক্ষুগণ পাতিমোক্ষ আবৃত্তি, ধর্ম-দেশনা, ধর্মালোচনা এবং ধ্যান-সমাধি চর্চা করে দিন অতিবাহিত করেন।
গৃহী বৌদ্ধরা উপোসথ দিবসে বিহারে গিয়ে নানারকম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। সাধারণত গৃহী বৌদ্ধরা পঞ্চশীল পালন করেন। কিন্তু উপোসথ দিবসে তারা অষ্টশীল গ্রহণ করে উপবাস পালন করেন। যারা উপোসথ পালন করেন তাঁদের উপোসথিক বলা হয়। উপোসথিকরা ধর্ম শ্রবণ ও ধ্যান-সমাধি চর্চা করেন। সংযত জীবনযাপন করেন। অকুশল কর্ম হতে বিরত থাকেন। শ্রদ্ধচিত্তে দান প্রদান করেন।
অতএব বৌদ্ধদের কাছে উপোসথ শুধু উপবাস থাকা নয়। শীল পালনের ব্রত গ্রহণ করে চিত্ত শুদ্ধ করাই আসল লক্ষ্য। চিত্তকে শুদ্ধ করতে পারলে তৃষ্ণাকে ক্ষয় করা সম্ভব। তৃষ্ণা ক্ষয় হলে লোভ-দ্বেষ-মোহের উচ্ছেদ হয়। এতে দুঃখমুক্তি সম্ভব হয়। দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করাই মূলত বৌদ্ধদের জীবনের পরম লক্ষ্য। তাই উপোসথ এবং সাধারণ উপবাসের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।
উপোসথ পালনের নিয়মাবলি
উপোসথ পালনকারী গৃহীদের অনেক নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। উপোসথ গ্রহণেচ্ছুক উপাসক-উপাসিকাগণ উপোসথ দিবসে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠবেন। প্রাতঃকৃত্যসহ স্নানাদি শেষ করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধানপূর্বক পূজা ও দানের উপকরণ নিয়ে পবিত্র মনে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের গুণরাশি স্মরণ করতে করতে সংযতভাবে বিহারে যাওয়া সমীচীন। বিহারে পৌছে পূজা ও বন্দনার কাজ সম্পাদনের পর ভিক্ষুর কাছ থেকে উপোসথ শীল গ্রহণ করবেন। কোন কারণে বিহারে উপস্থিত হতে না পারলে গৃহে উপোসথ শীল গ্রহণ করা যায়। উপোসথ শীল গ্রহণের পর সুসংষতভাবে জপমালায়, ধর্মগ্রন্থে, ধর্মালোচনায় বা ধ্যানে চিত্তকে নিবিষ্ট রাখা কর্তব্য। লোভ, দ্বেষ, মোহ, বিলাসিতা প্রভৃতি ত্যাগ করে প্রতিটি মুহূর্ত ধর্ম ও কুশল চিন্তা করে অতিবাহিত করা উচিত।
চলাফেরায়, অবলোকনে এবং ভাষণে সংযতভাব বজায় রাখতে হবে। প্রাণিহত্যা, চুরি বা অদত্ত বস্তু গ্রহণ, ব্রহ্মচর্য আচরণ, মিথ্যা ভাষণ, নেশাদ্রব্য গ্রহণ, বিকাল ভোজন, নৃত্য-গীত-বাদ্যে প্রমত্ততা দর্শন এবং অলঙ্কার ও সুগন্ধ দ্রব্য ব্যবহার, উচ্চশয্যা ও মহাশয্যায় শয়ন প্রভৃতি হতে বিরত থাকতে হবে। সকল প্রাণীর প্রতি দয়াশীল আচরণ করতে হবে।
অতঃপর উপোসথিকের এরূপ অধিষ্ঠান করা উচিত- “আমি কারও অনিষ্ট কামনা করব না। কোনো প্রাণীকে কষ্ট দেব না। কষ্ট প্রদানের কারণও হব না। নিজেও অনাচার, অত্যাচার করব না, এর কারণও হব না। পরের ধনে লোভ করব না। কারও লাভ-সৎকারের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হব না, বরং সাধুবাদের সাথে তা অনুমোদন করব। কোনো প্রকার মিথ্যা বিষয়ের পরিকল্পনা করব না। গৃহকর্ম বিষয়ে আলোচনায় রত হব না। গৃহীজনোচিত আচার-আচরণ থেকে মুক্ত থাকব। শুধু ধর্মশ্রবণ, ধর্মালোচনা ও ধর্মচিন্তা করে দিন অতিবাহিত করব।
উপোসথের প্রকারভেদ
অনুসরণ রীতি ও সময় অনুসারে উপোসথ পাঁচ প্রকার। যথা:
- ১. প্রতিজাগর উপোসথ
- ২. গোপালক উপোসথ
- ৩. নিগ্রন্থ উপোসথ
- ৪. আর্য উপোসথ এবং
- ৫. প্রতিহার্য উপোসথ
১. প্ৰতিজাগর উপোসথ: সার্বক্ষণিক সজাগ থেকে অত্যন্ত, সচেতন ও যত্নের সঙ্গে অষ্টশীল পালন করার নাম প্রতিজাগর উপোসথ। উপোসথে উপোসথিককে রাতে ঘুমের সময় ছাড়া অন্য সময় প্রতিটি নিয়ম যথাযথভাবে পালন করতে হয়। এরূপ শীল গ্রহণকারীগণ উপোসথের দিন ছাড়া অন্যান্য দিনেও উপোসথ পালন করেন।
২. গোপালক উপোসথ: যে উপোসথ গ্রহণকারী ধর্মচিন্তা বাদ দিয়ে খাদ্য, ভোজ্য, অভাব অনটন বিষয়ে চিন্তা করে তাকে গোপালক উপোসথ গ্রহণকারী বলে। গরু পরিচর্যাকারী রাখাল যেমন পরের গরু নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকে, তেমনি এরূপ উপোসথ গ্রহণকারীগণও করণীয় কর্ম না করে অসার ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে আলাপ করে সময় নষ্ট করে। এটি অত্যন্ত নিম্নস্তরের উপপাসথ।
৩. নির্গ্রন্থ উপোসথ: নির্গ্রন্থ অর্থ গ্রন্থহীন অর্থাৎ নগ্ন। গৌতম বুদ্ধের সময় একরকম নগ্ন সন্ন্যাসী ছিলেন। তারা যে উপোসথ গ্রহণ করতেন তাঁর নাম নির্গ্রন্থ উপোসথ। তারা স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করতেন। প্রাণিহত্যা থেকে বিরত থাকলেও নিজেদের প্রয়োজনে তাঁরা প্রাণিহত্যা করতেন। এতে কোনো পাপ হয় না বলে তারা অভিমত পোষণ করতেন। এরূপ আসক্তচিত্তে উপোসথ পালনকে নির্গ্রন্থ উপোসথ বলা হয়।
৪. আর্য উপোসথ: আর্য শব্দের অর্থ শ্রেষ্ঠ। এই উপোসথই শ্রেষ্ঠ উপোসথ। বুদ্ধ এই মহান উপোসথ ব্রতই প্রবর্তন করেছিলেন। বুদ্ধের শ্রাবকগণ এই উপোসথ পালন করতেন। আর্য উপোসথ গ্রহণকারীগণ উপোসথ গ্রহণ করে জাগতিক সুখ ভোগের চিন্তা ত্যাগ করেন। তাঁরা বুদ্ধানুস্মৃতি, ধর্মানুস্মৃতি, শীলানুস্মৃতি ও মৈত্রী ভাবনায় রত থেকে উপোসথব্রত পালন করেন। সকলের আর্য উপোসথ গ্রহণ ও পালন করা উচিত। অর্থাৎ অকৃত্রিমভাবে সশ্রদ্ধচিত্তে সকল নিয়ম অনুসরণ করে উপোসথ পালনই আর্য উপোসথ।
৫. প্রতিহার্য উপোসথ: বছরের কিছু সময় নির্দিষ্ট করে নিয়মিত উপোসথ পালনকে প্রতিহার্য উপোসথ বলে। এরূপ উপোসথ বিভিন্ন রকম হয়।
১. আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাস প্রতিদিন উপোসথ পালন করাকে বলে উৎকৃষ্ট প্রতিহার্য উপোসথ।
২. আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত কিংবা
৩. আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে পরবর্তী পনের দিনব্যাপী প্রতিদিন উপোসথ পালন করাকে হীন প্রতিহার্য উপোসথ বলে। এই তিন উপোথের যেকোনো এক রকম উপোসথ পালন করা খুব পুণ্যের। এগুলোকে প্রতিহার্য উপোসথ বলে।
উপোসথ পালনের সুফল
ত্রিপিটকের বহু স্থানে উপোসত পালনের সুফল বর্ণিত আছে। তাতে বলা হয়েছে, চন্দ্র-সূর্যের কিরণ পৃথিবীর অন্ধকার দূরীভূত করে। এজন্য চন্দ্র-সূর্যকে প্রাণী জগতের জীবন বলা হয়। কিন্তু উপোসথ শীলের গুণের সঙ্গে তুলনা করলে চন্দ্র-সূর্যের গুণ অতি সামান্য।
পৃথিবী ও সাগরের সমস্ত সম্পদ, হীরা ও মণিরত্ন অষ্টাঙ্গ উপোসথ শীলের তুলনায় তুচ্ছ। এমনকি দেবতাদের ঐশ্বর্যও এর কাছে নগণ্য। স্বর্গীয় আনন্দ উৎকৃষ্টতর হলেও ক্ষণস্থায়ী কিন্তু উপোসথ শীলের দ্বারা অর্জিত আনন্দ অবিনশ্বর ও চির শান্তিদায়ক।
উপোসথ শীলের অনাবিল শান্তিময়ী দীপ্তি চন্দ্র, সূর্য, হীরা-মণি-মুক্তার উজ্জ্বল প্রভা, দেবতার দিব্যজ্যোতি সবকিছুকেই পরাভূত করে। ফুলের সুগন্ধ বাতাসের অনুকূলে প্রবাহিত হলেও উপোসথ শীলের গুণ সৌরভ বাতাসের অনুকুল-প্রতিকূল এবং চতুর্দিকে প্রবাহিত হয়।
একসময় তাবতিংস স্বর্গের রাজা দেবরাজ ইন্দ্র অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, হে দেবতাগণ। তোমরা যদি আমার মতো ইন্দ্র হতে ইচ্ছা কর তাহলে পূর্ণিমা, অষ্টমী ও অমাবস্যায় আট অঙ্গের উপোসথ শীল পালন কর। আর এর চেয়েও যারা পুণ্যকামী তারা প্রতিজাগর, প্রতিহার্য উপোসথ পালন কর। এভাবে তোমরা নিজেকে সম্যক পথে পরিচালিত কর।’
দেবরাজ ইন্দ্র আরও বলেছেন; যে গৃহী নিজের স্ত্রী-পুত্রের ভরণপোষণ করেন, যিনি পুণ্যবান ও শীলবান এবং ত্রিরত্নের উপাসক, তাঁকে আমি নমস্কার করি, আমরা জানি দেবতারা উচ্চ মার্গের সত্ত্বা হলেও সম্পূর্ণ মুক্ত নন। তাঁদের মধ্যে রাগ, দ্বেষ ও মোহ আছে। তবে তাঁরা দিব্য চোখে মানুষের পুণ্য ও অপুণ্য দেখতে পান। মানুষের মধ্যে যারা সদ্ভাবে জীবনযাপন করেন, বড়দের ভক্তি ও শ্রদ্ধা করেন, মাতাপিতার উপযুক্ত ভরণপোষণ করেন, উপযুক্ত সময়ে উপোসথ পালন করেন তাঁদের উন্নতিতে দেবতারা প্রশংসা করেন। স্বয়ং ইন্দ্র তাঁদের শ্রদ্ধা করেন।
মহাকারুণিক বুদ্ধ প্রবর্তিত মহামূল্যবান আট অঙ্গের উপোসথ শীল মহাফলদায়ী। তাই উপোসথ শীল আমাদের সঠিকভাবে পালন করা উচিত ।
আরো পড়ুন>>
- ৮৪০০০ ধর্ম স্কন্ধ অনুবাদের উদ্যোগ নিয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি।
- বাংলাদেশে বৌদ্ধ গণনা শুরু।
- বুদ্ধ পূর্ণিমা সম্পর্কে বিস্তারিত।
- দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হতে বুদ্ধ কি করতে বলেছেন।
- ধন সম্পদকে ৪ ভাগে ভাগ করবে। -বুদ্ধ
- সকল বন্দনা, দান, পূজা, গাথা, জাতক, ধর্মীয় বই, ভিডিও পেতে এখানে ক্লিক করুন।