- ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু:
শ্রদ্ধায় স্মরণীয় মহান ব্যক্তিত্ব জেম্স প্রিন্সেপ (২০শে আগষ্ট, ১৭৯৯-২২ শে এপ্রিল, ১৮৪০) মহোদয়ের আজ প্রয়ান বার্ষিকী। ১৮৪০ সালের ২৩ এপ্রিল ৪১ বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি তাঁর কর্ম জীবনে যে অবিস্মরণীয় কীর্তি স্থাপন করে গিয়েছেন, তজ্জন্য বিশ্বের ইতিহাস ও ঐতিহ্য প্রেমীদের নিকট তিনি শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত আছেন। তাঁর অমর অবদানের জন্য আজ তাঁকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
জেম্স প্রিন্সেপ ছিলেন ইতিহাস সংশোধক, ইতিহাস পুনরুদ্ধারক ও অসোক শিলালিপির পাঠোদ্ধারক।
মাত্র বিশ বছর বয়সে জেম্স প্রিন্সেপ ইংল্যাণ্ড হতে বঙ্গের খনি কর্মকর্তারূপে যোগদান করে কাজ করার সময় তিনি অনেক প্রকারের ধাতব মুদ্রা হস্তগত করেছিলেন। তাতে ভারতীয় প্রাচীন মুদ্রা সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ এবং অনুসন্ধিৎসা বাড়তে লাগল। ঠিক অনুরূপ কাজে জেম্স টোড রাজপুতনায় কর্মরত থাকার সময় যবন, শক, কুষাণ কালীন অনেক মুদ্রা আবিস্কার করেছিলেন।
সে সময় কর্ণেল টোড কর্তৃক গুজরাতে সম্রাট অসোকের গির্ণার অভিলেখ উদ্ধার করেছিলেন। অন্যদিকে ইঙ্গেরিয়ান সংশোধক ক্ষোমা ডি করোস উড়িষ্যার খণ্ডগিরিতেও অসোকের অভিলেখ আবিস্কার করেছিলেন। বৃটিশ কর্মকর্তা হোগসনও নেপালে স্বীয় কার্যকালের সময় বিহারের লৌরিয়া-নন্দিগড় স্তম্ভ অভিলেখের সন্ধান পেয়েছিলেন।
জর্জ টর্নর কর্তৃক শ্রীলঙ্কায় দীপবংশ এবং মহাবংশের মত প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ লাভ করে এগুলির ইংরেজীতে অনুবাদ করেছিলেন। নিজেদের এ সমস্ত গবেষণাপূর্ণ অনুসন্ধান ‘বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটি’তে পাঠানো হয়েছিল এবং সে সম্পর্কে ‘এশিয়াটিক রিচার্স’ পত্রিকায় তাঁদের সংশোধন বা গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল।
জেম্স প্রিন্সেপ অত্যন্ত যুক্তিবাদী এবং বুদ্ধিমান সংশোধক হওয়ার কারণে তাঁকে খুব শীঘ্রই বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটির মুখ্য কর্মকর্তা পদ দেওয়া হয়েছিল। পৃথক পৃথক সংশোধক বা গবেষক কর্তৃক পাঠানো স্তম্ভ লেখ (Pillar Edicts) এবং পাষাণ লেখ (Stone Edicts) সমূহ প্রচুর পরিমাণে লাভ হচ্ছিল। কিন্তু এ সমস্ত অভিলেখ কে লিখেছিলেন, কখন লিখেছিলেন এবং তাতে কি বার্তা রয়েছে, তা কেহই বুঝতে পারছিলেননা। কেননা সেগুলি কেহ পাঠোদ্ধারে সক্ষম ছিলেননা।
জেম্স প্রিন্সেপ যে কোন প্রকারে অভিলেখ সমূহ পড়তে আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। সেজন্য তিনি বিভিন্ন মুদ্রা, স্তম্ভ লেখ এবং শিলালেখ সমূহের প্রতিলিপি কাগজে তৈরী করলেন এবং সেগুলির তুলনাত্মক অধ্যয়ন করতে আরম্ভ করলেন। এরূপ তুলনাত্মক অধ্যয়নে জানতে পারলেন যে, সমস্ত অভিলেখ একই স্ক্রিপ্টে বা লিপিতে লিখা হয়েছে এবং সেগুলির মূল ভাষা হল মাগধী, যাকে বৌদ্ধ সাহিত্যে পালি ভাষা বলা হয়।
স্যার উইলিয়াম জোন্সের মত প্রিন্সেপও গ্রীক, পার্শিয়া, পালি, সংস্কৃত, উড়িয়ার মত ভাষার তুলনাত্মক অধ্যয়ন করছিলেন এবং তাতে জানতে পারলেন যে, সমস্ত অভিলেখের ভাষা হল একইরকম। সেগুলি মূল মাগধী ভাষাতে তৈরী হয়েছে। উইলিয়ম জোন্সের এ সিদ্ধান্তকে জেম্স প্রিন্সেপ বৈজ্ঞানিক স্তরে প্রমাণিত করলেন। ইতিহাসে তিনি ‘দ্বিতীয় জোন্স’ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছেন।
১৮৩৭ খৃষ্টাব্দে ভারতের ইতিহাসে এক ‘সুবর্ণবর্ষ’ প্রমাণিত হয়েছে। তখন জেম্স প্রিন্সেপ প্রাচীন অভিলেখ সমূহ দক্ষতার সাথে পড়তে সফল হয়েছিলেন। তিনি প্রাচীন স্ক্রিপ্ট কিভাবে পড়তে সক্ষম হয়েছিলেন তা ছিল এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তা সংক্ষেপে এখানে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
জেম্স প্রিন্সেপকেও ভুল পথে পরিচালিত করার জন্য বারাণসীর ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা জ্ঞাপন করেছিলেন যে, এ লিপি ( স্ক্রিপ্ট) স্বয়ং ব্রহ্মাই তৈরী করেছেন। এজন্য এ লিপিকে ‘ব্রাহ্মীলিপি’ বলা হয়। কিন্তু যুক্তিবাদী এবং অনুসন্ধিৎসু সত্যগবেষক জেম্স প্রিন্সেপের নিকট ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দাবী মনপুত হয়নি। তিনি মনে করেছেন কোন শক্তিমান বড় রাজা-মহারাজা কর্তৃক এ অভিলেখ লিখা হতে পারে।
তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ইহাই ছিল। কেননা সর্বত্র একই লিপিতে বার্তা লেখা হয়েছিল। সত্য ইতিহাস অনুসন্ধান করার তীব্র আকাঙ্খা হতে ‘সত্য শোধক প্রিন্সেপ’ এর মনকে ভারতের সত্য ইতিহাস আবিস্কারে অগ্রণী স্থানে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে এবং এরকম আকাঙ্খার দ্বারা প্রেরণা লাভ করে তিনি অবশেষে অভিলেখ পড়তে সফলও হলেন এবং তাঁর অদম্য প্রচেষ্টায় সম্রাট অসোক দুনিয়ার বুকে আবার সগৌরবে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেন।
সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা লিপিকে নিখুঁতভাবে পড়া ছিল অত্যন্ত জটিল এক কাজ। কিন্তু জেম্স প্রিন্সেপ প্রাচীন অজানা-অচেনা লিপিকে পাঠোদ্ধার করে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে এক অসাধারণ অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক কাজ করেছেন।
ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতদের মিথ্যা প্রচারণা এবং তাঁদের লিখিত পুরাণ সমূহের খপ্পরে না পরে তিনি সত্য ইতিহাসকে অনুসন্ধান করেছেন। এজন্য উইলিয়াম জোন্সের মত জেম্স প্রিন্সেপও হলেন আমাদের জন্য এক আদর্শ সংশোধক, গবেষক ও আবিস্কারক। আমরা তাঁর নিকট অশেষ ঋণী হয়ে রয়েছি।
তিনি অসোক অভিলেখ পাঠোদ্ধারে জানতে পারলেন যে, এতদিন ব্রাহ্মণেরা ব্রাহ্মী লিপি বলে যে মিথ্যা প্রচার করে আসছিলেন, তাহল বাস্তবিকভাবে ধম্মলিপি।
ভারতের বর্তমান ইতিহাস গবেষকদেরও জেম্স প্রিন্সেপের মত ব্রাহ্মণ্য লিখিত পুরাণ গ্রন্থ সমূহকে এক পাশে রেখে ভারতের বাস্তবিক বৌদ্ধ ইতিহাস খোঁজার প্রচেষ্টা করা উচিত। বর্তমানে কোন ইতিহাস গবেষককেই সে রাস্তায় হাঁটতে দেখা যায়না। তাঁরা পুরাণে বর্ণিত কাল্পনিক ইতিহাস প্রচারে ব্যস্ত রয়েছেন।
এভাবে সত্যিকার গবেষক হওয়া যায়না। তজ্জন্য সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও সত্য অনুসন্ধানের জন্য আগ্রহ হওয়া অতীব আবশ্যক। জেম্স প্রিন্সেপ ছিলেন মহান গবেষক, সত্য সন্ধানী এবং খ্যাতিমান ঐতিহাসিক। তাঁর কারণেই হারিয়ে যাওয়া বৌদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সম্রাট অসোক মহান পৃথিবীর বুকে পুনরায় আলোর মুখ দেখেছে। এমন মহান গবেষক ও আবিস্কারক জেম্স প্রিন্সেপের প্রয়াণ দিবসে আজ সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি।
আরো পড়ুন>>
- দক্ষ ও গুণী ভিক্ষু চায় বৌদ্ধ সমাজ
- আষাঢ়ী পূর্ণিমা কোন গুরুত্বপূর্ণ
- শ্রীলংকাবাসীর উদারতায় মুগ্ধ
- জীব হত্যা নয়, প্রাণি হত্যা থেকে বিরত থাকবো
- বৌদ্ধরা কেন সকল প্রাণির প্রতি পূণ্যদান করেন