শমত ও বিদর্শন ভাবনা করার পূর্ণাঙ্গ গাইডঃ আনাপান স্মৃতি

আনাপান স্মৃতি

বুদ্ধ দীর্ঘ নিকায়ের মহাসতিপটঠান সূত্রে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে কীভাবে ভাবনা করতে হয়, তা বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ভিক্ষুগণ, এই বুদ্ধ শাসনে একজন ভিক্ষু বনে, বা কোনো গাছের গোড়ায়, অথবা খালি কোন জায়গায় গিয়ে পদ্মাসনে বসে এবং শরীরকে সোজা রাখে। সে তার মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করে ধ্যানের বিষয়ের [আলম্বনের] উপরে। সে মনোযোগের সাথে শ্বাস নেয় ও মনোযোগের সাথে শ্বাস ফেলে।

  • ১. দীর্ঘ করে শ্বাস নেওয়ার সময় সে জানে, “আমি দীর্ঘ করে শ্বাস নিচ্ছি, দীর্ঘ করে শ্বাস ফেলার সময় সে জানে, “আমি দীর্ঘ করে শ্বাস ফেলছি”।
  • ২. ছোট করে শ্বাস নেওয়ার সময় সে জানে, “আমি ছোট করে শ্বাস নিচ্ছি, ছোট করে শ্বাস ফেলার সময় সে জানে, “আমি ছোট করে শ্বাস ফেলছি”।
  •  ৩. “সম্পূর্ণ শ্বাসপ্রবাহ অনুভব করে করে আমি শ্বাস নেব”, এভাবে সে ভাবনা করে ” সম্পূর্ণ শ্বাসপ্রবাহ অনুভব করে আমি শ্বাস ফেলব”, এভাবে সে ভাবনা করে।
  • ৪. “শ্বাপ্রবাহ শান্ত করে আমি শ্বাস নেব”, এভাবে সে ভাবনা করে “শ্বাসপ্রবাহ শান্ত করে আমি শ্বাস ফেলব”, এভাবে সে ভাবনা করে”।

প্রথম ধাপ

ভাবনা শুরু করার আগে, যুতসই একটা জায়গায় বসুন এবং নাকের মধ্য দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের ভেতরে ঢোকা ও বেরিয়ে যাওয়াটা খেয়াল করার চেষ্ট করুন।  আপনি এটাকে নাকের ডগার নীচে অথবা নাকের পাটার চারপাশের কোথাও অনুভব করতে পারবেন। শ্বাস নেওয়ার ও ফেলার সময় শ্বাসপ্রবাহকে অনুসরণ করবেন না, কারণ এতে করে আপনার ভাবনা যথাযথ হবে না।  সজাগ মনোযোগ রাখুন শ্বাস যেখানে অথবা যে জায়গায় স্পর্শ করে সেই জায়গাতে- সেটা হয় উপরের ঠোঁটের উপরিভাগে অথবা নাকের ডগার আশেপাশে কোন জায়গায়।

একটামাত্র জায়গায় সজাগ মনোযোগ রাখলে তখন আপনি ভালোভাবে ভাবনা করতে শিখবেন ও সেটাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে তুলতে পারবেন।

নিমিত্ত স্বাভাব-লক্ষণ (সম্মঞ্ঞ-লক্ষণ) অথবা নিমিত্তের রঙের প্রতি মনোযোগ দেবেন না। এখানে স্বভাব-লক্ষণ হচ্ছে শ্বাসের মধ্যে চারি মহাভূতের (আগুন, পানি, মাটি, বায়ু) অনুভূতি, কাঠিন্য, কর্কশতা, প্রবাহ, তাপ, ধারকত্ব, চাপ ইত্যাদি। সাধারণ-লক্ষণ হচ্ছে শ্বাসের অনিত্যতা, দুঃখ ও অনিত্যতার বৈশিষ্ট্য। এর মানে হচ্ছে ’শ্বাস নিচ্ছি, ফেলছি, অনিত্য অথবা, ’শ্বাস নিচ্ছি ফেলছি অনাত্ম’ এভাবে মনোযোগ দেবেন না। শুধুমাত্র শ্বাস নেওয়া ও ফেলার কাজে মনোযোগ দিন, অন্য কিছুতে মনোযোগ দিবেন না।

শ্বাস-প্রশ্বাসের ভাবনায় শ্বাস-প্রশ্বাস হচ্ছে ভাবনার বিষয়বস্তু। ভাবনায় উন্নতির জন্য আপনি এটাতেই মনোযোগ দেবেন। আপনি যদি এভাবে শ্বাস-প্রশ্বসের মনোযোগ দিতে থাকেন এবং সেই সাথে যদি আপনি পূর্বজন্মেও ভাবনাচর্চা করে থাকেন ও কিছু পারমী সঞ্চার করে থাকেন, তাহলে খুব সহজেই শ্বাস-প্রশ্বাসের উপরে মনোযোগ স্থাপন করতে পারবেন, শ্বাস নেওয়া ও ফেলার কাজে মনোযোগ রাখতে পারবেন।

তাতে যদি মনোযোগ না আসে তাহলে বিশুদ্ধিমার্গ মতে আপনি শ্বাস-প্রশ্বাস গণনা করতে পারেন। আপনি প্রত্যেক শ্বাসপ্রশ্বাসের শেষে এভাবে গুণবেন; ‘শ্বাস নিচ্ছি-ফেলছি-এক’, ‘শ্বাস নিচ্ছি-ফেলছি-দুই,’  ইত্যাদি।

কমপক্ষে পাঁচ পর্যন্ত গুণুন, তবে দশের উপরে গুণবেন না। আমরা আপনাকে আট পযর্ন্ত গুণতে পরামর্শ দেব, কেননা এটি আপনাকে আর্য-অষ্টাঙ্গিক পথের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে, যে পথ ধরে আপনি চলার চেষ্টা করছেন। তাই আপনি পাঁচ থেকে দশের মধ্যে যে কোন সংখ্যা পর্যন্ত গুণুন। আপনি প্রতিজ্ঞা করুন যে এই সময়ের মধ্যে আপনি মনকে অন্য চিন্তায় বা কল্পনায় ভেসে যেতে দেবেন না, অন্য কোথাও যেতে দেবেন না, শুধুমাত্র শ্বাস-প্রশ্বাসের উপরে সজাগ মনোযোগ রাখবেন।

যখন এভাবে গুণবেন, আপিন দেখেবন যে এখন আপিন শ্বাস-প্রশ্বাসের উপের মনোযোগ রাখেত পারেছন এবং কেবল শ্বাস-প্রশ্বাসকেই জানছেন, অন্য কিছু নয়।



দ্বিতীয় ধাপ

এভাবে মনকে কমপক্ষে- আধাঘন্টা কেন্দ্রীভূত করে রাখার পরে, আপিন এবার

দ্বিতীয় ধাপে যেতে পারেন:

  • ১. দীর্ঘ করে শ্বাস নেওয়ার সময় সে জানে, “আমি দীর্ঘ করে শ্বাস নিচ্ছি”। দীর্ঘ করে শ্বাস ফেলার সময় সে জানে, “আমি দীর্ঘ করে শ্বাস ফেলিছ”।
  • ২. ছোট করে শ্বাস নেওয়ার সময় সে জানে, “আমি ছোট করে শ্বাস নিচ্ছি ছোট করে শ্বাস ফেলার সময় সে জানে, “আমি ছোট করে শ্বাস ফেলছি”।

এই ধাপে এসে আপনাকে সজাগ ও সচেতন থাকার চেষ্টা করেত হবে শ্বাস প্রশ্বাস দীর্ঘ বা ছোট কিনা এই বিষয়ে। ‘দীর্ঘ’ বা ‘ছেট’ বলতে এখানে কয় ফুট বা কয় ইঞ্চি দীর্ঘ, সেটা বুঝাচ্ছে না, সময়ের পিরমাণটাকে বুঝাচ্ছে। আপনাকে নিজে নিজেই ঠিক করে নিতে হবে, কতটুকু সময়কে আপনি ‘দীর্ঘ’ বলেবন, আর কতটুকু সময়কে ‘ছোট’ বলেবন। প্রত্যেকটি শ্বাস নেওয়া ও শ্বাস ফেলার সময় সম্পর্কে সজাগ মনোযোগ বজায় রাখুন। আপনি খেয়াল করেবন যে নিঃশ্বাস কখেনা দীর্ঘ হচ্ছে, কখেনাবা ছোট হচ্ছে। শুধুমাত্র এই জানার কাজটাই করেত হবে আপনাকে এই ধাপে। মনে মেন বলেবন না যেন ‘শ্বাস নিচ্ছি, ফেলছি, দীর্ঘ-শ্বাস নিচ্ছি, ফেলছি’, ছোট্ট—’, এভাবে বলার দরকার নেই এখন। শুধু মনে মনে বলুন,’শ্বাস নিচ্ছি , ফেলছি’, আর সজাগ থাকুন শ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘ হচ্ছে কি ছোট হচ্ছে সে বিষয়ে। শ্বাস নেওয়ার ও ফেলার সময় তা উপেরর ঠোঁট বা নাকের ডগায় কতক্ষণ ধরে স্পর্শ করছে, তা থেকেই আপনি এটা জেনে যাবেন। মাঝে মাঝে হয়তো পুরো সময়টা জুড়ে শ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘ হবে অথবা মাঝে মাঝে হয়তো পুরো সময়টা জুড়ে শ্বাস-প্রশ্বাস হবে ছোট ছোট, কিন্তু আপনি স্বেচ্ছায় এটাকে দীর্ঘ বা ছোট করতে যাবেন না।

এই ধাপে নিমিত্ত দেখা দিতে পারে, কিন্তু যদি আপনি ধীর ও শান্তভাবে এক ঘন্টা ধরে এই ধাপে ভাবনা করতে পারেন, এবং এ সময়ে কোন নিমিত্ত আবির্ভূত না হয়, তখন আপনার তৃতীয় ধাপে এগোনো উচিত:

তৃতীয় ধাপঃ

  •  ৩. “সম্পূর্ণ শ্বাসপ্রবাহ অনুভব করে আমি শ্বাস নেব”, এভাবে সে ভাবনা করে। “সম্পূর্ণ শ্বাসপ্রবাহ অনুভব করে আমি শ্বাস ফেলব”, এভাবে সে ভাবনা করে।

এখানে বুদ্ধ আপনাকে পুরো শ্বাসপ্রবাহের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, খেয়াল রাখতে নিদের্শ দিয়েছেন। যখন আপনি এটা করতে যাবেন, নিমিত্ত আবির্ভূত হতে পারে। সেরকম হলে আপনি তৎক্ষণাৎ সেদিকে মন দেবেন না, শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে থাকুন।

যদি আপনি এক ঘন্টা ধরে শ্বাস-প্রশ্বাসের শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত, ধীর ও

শান্তভাবে মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন, আর কোন নিমিত্ত আবির্ভূত না হয়, তখন

আপনার চতুর্থ ধাপে যাওয়া উচিত:



চতুর্থ ধাপঃ

  • ৪. “শ্বাসপ্রবাহ শান্ত করে আমি শ্বাস নেব”, এভাবে সে ভাবনা করে “শ্বাসপ্রবাহ শান্ত করে আমি শ্বাস ফেলব”, এভাবে সে ভাবনা করে।’

এটা করতে গিয়ে আপনার মনে মনে ঠিক করা উচিত যে শ্বাস-প্রশ্বাস শান্ত করতে হবে, কিন্তু তাই বলে শ্বাস-প্রশ্বাস শান্ত করার জন্য অন্য কিছু করতে যাবেন না যেন। শুধু পুরো শ্বাসপ্রবাহের শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত মনোযোগ ধরে রাখুন, আর কিছু করার দরকার নেই। যদি আপনি অন্য কিছু করতে যান, তবে আপনার মনোযোগ ভঙ্গ হবে এবং মন অন্য দিকে সরে যাবে।

বিশুদ্ধি মার্গ বলে যে, শ্বাস-প্রশ্বাস শান্ত হওয়ার চারটি পূর্বশর্ত আছেঃ চিন্তা(আভোগ), বার বার স্মৃতি দেওয়া (সমন্নাহার), মনোযোগ (মনসিকার), এবং বিচার(বীমংস)। তাই এই ধাপে আপনাকে যা করতে হবে, তা হলো শ্বাস-প্রশ্বাস শান্ত করার সিদ্ধন্ত নেওয়া এবং এ বিষয়ে ক্রমাগততভাবে সজাগ থাকা। এভাবে আপনি দেখবেন যে শ্বাস-প্রশ্বাস শান্ত থেকে শান্ততর হবে। এসময় নিমিত্ত আবির্ভূত হতে পারে।

নিমিত্ত আবির্ভূত হওয়ার ঠিক আগের মুহুর্তে অনেকেই বিভিদ অসুবিধার সছুখীন হন। বেশির ভাগ লোকের তখন মনে হয় যে শ্বাস-প্রশ্বাস খুব সুক্ষ্ম হয়ে গেছে এবং সেটি স্পষ্টত অনুভূত হচ্ছে না। তারা হয়তো মনে করতে পারে শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে গেছে। যদি এমন হয়, তখন আপনি সর্বশেষ যেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করেছিলেন, সেখানে মনোযোগ ধরে রাখা উচিত এবং সেখানে ধৈয্যের সাথে অপেক্ষা করা উচিত।

মৃত ব্যক্তি, মাতৃগর্ভের ভ্রুণ, জলে নিমজ্জিত ব্যক্তি, অজ্ঞান ব্যক্তি, চতুর্থ ধ্যানে নিমগ্ন ব্যক্তি, নিরোধ সমাপত্তি ধ্যানে নিমগ্ন ব্যক্তি এবং ব্রহ্মা এই সাত অকার ব্যক্তি শ্বাস নেয় না। চিন্তা করে দেখুন, আপনি এগুলোর কোনটাই নন, আপনি আসলেই শ্বাস নিচ্ছেন, এটা শুধু খুব সুক্ষ্ম হয়ে গেছে, যার ফলে আপনার দুর্বল মনোযোগের কারণে সেটাকে অনুভব করতে সক্ষম হচ্ছে না। আপনার মনোযোগ যথেষ্ট শক্তিশালী না হওয়ায় আপনি শ্বাস-প্রশ্বাসকে ধরতে পারছেন না।



যখন শ্বাস-প্রশ্বাস এরকম সূক্ষ্ম হয়, তখন আপনার এটাকে বদলানো উচিত নয়, কেননা এমন প্রচেষ্ট আপনাকে উত্তেজিত করবে মাত্র এবং এতে আপনার ধ্যানের কোন উৎকর্ষ সাধিত হবে না। আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস যেমন, সেভাবেই আপনি জানুন, কোন কিছু করতে যাবেন না। যদি এটি ধরতে না পারেন, তবে অপেক্ষা করুন সর্বশেষ যেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করেছিলেন সেখানে। আপনি দেখবেন যে, যখন আপনি আপনার মনোযোগ ও প্রজ্ঞাকে এভাবে কাজে লাগাবেন, শ্বাস-প্রশ্বাস আবার অনুভূত হবে।

শ্বাস-প্রশ্বাসের ধ্যানের নিমিত্ত ব্যক্তি বিশেষে বিভিন্ন হয়। কারো কারো নিমিত্ত হয় কার্পাস তুলার মতো খাঁটি ও সুক্ষ্ম, বায়ু প্রবাহের মতো প্রবাহমান, উজ্জ্বলতায় সেটি হয়তো শুকতারা, চুনি বা  রত্ন অথবা মুক্তার মতো। অন্যদের কাছে এটি হয় গাছের গুঁড়ি বা সুঁচালো বর্শার মতো। কারো কারো কাছে এটি লম্বা দড়ি বা রশি, কোন ফুলের মালা, ধোঁয়ার পুঞ্জ, কোন মাকড়সার জাল, কোন কুয়াশার দলা, কোন পদ্মফুল, কোন চাকা, চন্দ্র বা সূর্য ইত্যাদি।

বেশির ভাগ ক্ষেতে কার্পাস তুলার মতো খাঁটি সাদা নিমিত্ত হচ্ছে উদগ্রহ নিমিত্ত (যে ছবি বা চিহ্নটাকে ভিত্তি করে ধ্যানে এগোতে হবে), যা সাধারণত নিরস ও নিরেট। যখন এই নিমিত্ত শুকতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, দীপ্তমান ও পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তখন এটি প্রতিভাগ নিমিত্ত (চিহ্ন বা ছবির উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি)। যখন ঘোলাটে কোন রত্ন পাথরের মতো হয়, তখন এটি উদগ্রহ নিমিত্ত, কিন্ত যখন উজ্জ্বল ও ঝিকমিক করে দীপ্তি ছড়ায়, তখন এটি প্রতিভাগ নিমিত্ত। অন্যাণ্য নিমিত্ত গুলোকেও এভাবে বুঝে নিতে হবে।

নিমিত্ত বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্নভাবে হাজির হয়, কারণ এটি সংজ্ঞা দ্বারা উৎপন্ন। নিমিত্ত আবির্ভাবের আগে বিভিন্ন ভাবনাকারীর সংজ্ঞা বিভিন্ন হওয়ার কারণে নিমিত্তও বিভিন্নভাবে ভেসে আসে। যদিও এই ধ্যানে ভাবনার বিষয় কেবল শ্বাস-প্রশ্বাস, তবুও এটি ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের নিমিত্ত উপহার দেয়।

একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যখন আপনি এই ধাপে পৌছাবেন, তখন আপনার নিমিত্তকে নিয়ে খেলা করতে যাবেন না। এটাকে হারিয়ে যেতে দেবেন না, ইচ্ছকৃতভাবে এটির আকৃতি বা চেহারা বদলাতে যাবেন না। যদি আপনি সেরকম করেন, তবে আপনার ধ্যানের শ্রীবৃদ্ধি হবে না, আপনার অগ্রগতি সেখানেই থেমে যাবে। আপনার নিমিত্ত খুব সম্ভব হারিয়ে যাবে। তাই যখন প্রথম নিমিত আবির্ভূত হবে, তখন আপনি মনটাকে শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে নিমিত্তের দিকে যেতে দেবেন না। যদি যেতে দেন, তখন দেখবেন যে নিমিত্ত চলে গেছে।

যখন আপনি দেখবেন যে নিমিত্ত সুদৃঢ় ও সুধিত হয়েছে, আপনার মন নিজে থেকেই নিমিত্তে একাগ্র হয়ে আছে, তখন মনটাকে সেখানেই থাকতে দিন। যদি আপনি মনটাকে সেখান থেকে সরিয়ে আনেন, তাহলে খুব সম্ভব আপনি ধ্যানের মনোযোগ হারিয়ে ফেলবেন।



যদি নিমিত্ত আপনার কাছ থেকে অনেক দূরে আবির্ভূত হয়, সেটাকে উপেক্ষা করুন, কেননা এটি সম্ভবত হারিয়ে যাবে। যদি আপনি এটাকে উপেক্ষা করেন আর শ্বাস-প্রশ্বাস যেখানে স্পর্শ করে, সেখানে মনোযোগ ধরে রাখেন, নিমিত্ত আসবে এবং ধির হয়ে থাকবে।

শ্বাস-প্রশ্বাস যেখানে স্পর্শ করে, সেখানেই যদি নিমিত্ত আবির্ভূত হয়, সেটা যদি সুস্থির হয়, সেটা যদি এমনভাবে আবির্ভূত হয় যেন এটিই শ্বাস-প্রশ্বাস এবং শ্বাস-প্রশ্বাসটাই নিমিত্ত, তখন শ্বাস-প্রশ্বাসকে ভুলে যান, শুধু নিমিত্তে মনোযোগ ধরে রাখুন। মনটাকে শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে নিমিত্তে স্থানান্তিরিত করে আপনি এভাবে আরো অগ্রসর হতে সক্ষম হবেন।

এভাবে মনটাকে নিমিত্তে নিয়ে আসার ফেল নিমত্ত সাদা থেকে আরো সাদা হয়, যখন এটি তুলোর মতো সাদা হয়, তখন এটি উদগ্রহ নিমিত্ত।

আপনার দৃঢ় সংকল্প করা উচিত যে এই সাদা উদগ্রহ নিমিত্ত এক, দুই, তিন বা তারো বেশি সময় ধরে আপনি মনটাকে শান্তভাবে মনোযোগ ধরে রাখবেন। যদি উদগ্রহ নিমিত্ত এক বা দুই ঘন্টা ধরে মনটাকে ধরে রাখতে সমর্থ হন, তখন নিমিত্তটি আরো উজ্জ্বল, আরো পরিষ্কার, আরো দীপ্তিমান হওয়ার কথা। যদি তেমন হয়, তখন সেটাই প্রতিভাগ নিমিত্ত (উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি)। আপনার মনটাকে প্রতিভাগ নিমিত্তে এক, দুই বা তিন ঘন্টা ধরে ধরে রাখার সংকল্প করুন এবং সেভাবে ভাবনা প্র্যাটিস করুন। প্র্যাকটিস করুন, যতক্ষণ না আপনি সফল হন।

এই ধাপে আপনি হয় উপচার ধ্যানের স্তরে পৌছে গেছেন (যেটাকে বলা হয় ধ্যানের কাছাকাছি ধাপ), অথবা অপর্ণা ধ্যানের কাছাকাছি পৌছে গেছেন (যেটাকে বলা হয় অপর্ণা ধ্যান) । উপচার ধ্যান বলা হয় এই কারেণ যে, এটা ধ্যানের খুব কাছাকাছি এবং ধ্যানে প্রবেশর আগের ধাপ। গভীর মনোযোগই হচ্ছে ধ্যান।

উভয় ধ্যানের বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রতিভাগ নিমিত্ত। তাদের মধ্যে পাথক্য শুধু একটি জায়গায় আর সেটিই হচ্ছে, উপচার ধ্যানে ধ্যানের অঙ্গ গুলো পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে না। একারেণ ভবাঙ্গ চিত্ত উৎপন্ন হয় এবং আপনি ভবাঙ্গে (প্রতিসদ্ধি চিত্ত) পড়ে যেতে পারেন। ভাবনাকারী তখন বলেন যে, সবকিছু থেমে গেছে, আর মনে করতে পারেন যে এটিই নির্বাণ। আসলে কিন্তু মনটা থামেনি, ভাবনাকারী সুদক্ষ নন বলেই সেটা বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন না, কারণ ভবাঙ্গ চিত্তের গতি প্রকৃতি খুবই সুক্ষ্ণ।

ভবাঙ্গে পড়ে যাওয়াটা এড়াতে এবং আরো এগিয়ে যেতে আপনার প্রয়োজন হবে পঞ্চ ইদ্রিয়, যথা- শ্রদ্ধা বীর্য্য, স্মৃতি, সমাধি, এবং প্রজ্ঞাকে, যারা আপনার মনটাকে সামনের দিকে ঠেলে দেবে এবং প্রতিভাগ নিমিত্তে মনটাকে ধরে রাখবে। প্রতিভাগ নিমিত্তকে জানতে হলে বার বার প্রচেষ্টা চালাতে হয়, স্মৃতিকে সবসময় জাগ্রত রাখতে হয় যেন এটাকে না ভোলে, এবং ভালোমতো বুঝার জন্য তীক্ষ্ণ প্রজ্ঞার দরকার হয়।



কীভাবে আপনি পঞ্চ ইদ্রিয়ের মাঝে সমতা আনয়ন করবেন

পঞ্চ ইদ্রিয় হচ্ছে পাঁচটি শক্তি যা মনকে নিয়ন্ত্রণ করে, এবং শমথ ও বিদর্শনের পথ থেকে মনকে বিচ্যুত হতে দেয় না, যে পথ পৌছে গেছে নির্বাণে। যদি এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের কোনটা অতিরিক্ত হয়, তবে তা ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি করে।

প্রথম ইদ্রিয় হচ্ছে শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস। বিশ্বাস রাখতে হবে ত্রিরত্ন, অথবা কর্ম ও কর্ম ফলের উপরে। বুদ্ধের বুদ্ধত্বে বিশ্বাস রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এটা না হলে ধ্যানে তার অবনতি ঘটবে। বুদ্ধের শিক্ষাতে বিশ্বাস রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধের শিক্ষা হচ্ছে চার মার্গ, চার ফল ও নির্বাণ ইত্যাদি। বুদ্ধের শিক্ষা আমাদেরকে ভাবনায় পথ দেখায়, তাই প্রত্যেকটি ধাপে তার শিক্ষার প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাাস রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ধরা যাক ভাবনাকারী ভাবে, শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসকে দেখে দেখেই কি ধ্যান পাওয়া যাবে? এটা কি সত্যি যে উদগ্রহ নিমিত্ত হচ্ছে সাদা কার্পাস তুলার মতো, আর প্রতিভাগ নিমিত্ত হচ্ছে পরিষ্কার বরফ বা কাচের মতো?’ যদি এধরনের চিন্তা মনে সবসময় ঘুরপাক খায়, তবে তা একধরনের দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়, যেমন, ‘বর্তমান যুগে আর ধ্যান পাওয়া যাবে না। ‘ এতে করে বুদ্ধের শিক্ষা থেকে ভাবনাকারীর আস্থা কমে যাবে, শমথ ভাবনায় পরিপূর্ণতা লাভ করতে গিয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া থেকে সে আর নিজেকে থামাতে পারবে না।

তাই শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে ভাবনাকারী ব্যক্তির প্রবল বিশ্বাস থাকা দরকার। নিঃসন্দেহ হয়েই তার শ্বাস-প্রশ্বাসের ভাবনা করা উচিত। তার চিন্ত করা উচিত, ধ্যান লাভ করা সম্ভব, যদি আমি ঠিকমতো সম্যক সম্বুদ্ধের নির্দেনাশাবলী অনুসরণ করি। ‘

আবার কোন ব্যক্তি যদি কোন কিছুতে অতিরিক্ত মাত্রায় বিশ্বাাসপ্রবণ হয়ে পড়ে এবং এক্ষেত্রে সেটা যদি শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি হয়ে থাকে, তাহলে মাত্রাতিরিক্ত বিশ্বাসের কারণে প্রজ্ঞা (বিচার-বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়ার ক্ষমতা) সচ্ছ হয় না। অন্যান্য শক্তি গুলো যথা: প্রচেষ্টা, স্মৃতি, ও মনোযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রচেষ্টা শক্তি আর প্রতিভাগ নিমিত্তের উজ্জ্বল রূপ তৈরী করতে পারে না এবং মনটাকে সেখানে ধরে রাখতে পারে না। স্মৃতি প্রতিভাগ নিমিত্তের জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। মনোযোগ শক্তি মনকে তখন অন্য বিষয়বস্তুতে যেতে বাধা দিতে পারে না। প্রতিজ্ঞা শক্তি প্রতিভাগ নিমিত্তকে বিভাজন করে দেখতে ব্যর্থ হয়। যেহেতু প্রতিজ্ঞা শক্তি তখন প্রতিভাগ নিমিত্তকে বুঝতে ব্যর্থ হয় এবং বিশ্বাসসকে সহায়তা দিতে পারে না, তাই অতিরিক্ত বিশ্বাস এক্ষেত্রে আসলে বিশ্বাসটাকেই কমিয়ে দেয়।



যদি প্রচেষ্ট মাত্রারিক্ত হয়, তখন বিশ্বাস কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না, স্মৃতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, মনোযোগ মনের অমনোযোগিতাকে বাধা দিতে পারে না, প্রজ্ঞা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে না। তাই অতিরিক্ত প্রচেষ্টা মনকে প্রতিভাগ নিমিত্তে সুস্থিরভাবে রাখতে পারে না, এবং প্রশান্তি, মনোযোগ ও উপেক্ষা বোধ্যগুলো যথেষ্ট শক্তি অর্জন করতে পারে না।

বিজ্ঞ ব্যক্তিরা বিশ্বাসের সাথে প্রজ্ঞা ও মনোযোগের সাথে প্রচেষ্টার সাম্যতার প্রশংসা করেন। উদাহরণস্বরুপ, যদি বিশ্বাস প্রবল ও প্রজ্ঞা দুর্বল হয়, তাহলে কোন ব্যক্তি কোন বিষয়বস্তুতে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা স্থাপন করেন কোন কিছু না বুঝেই।

উদাহরণস্বরূপ, তিনি প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের বাইরের বিষয়বস্তু যেমন, রক্ষাকারী দেবতাদের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা স্থাপন করেন। অন্যদিকে যদি প্রজ্ঞা শক্তিশালী ও বিশ্বাস দুর্বল হয়, সেই ব্যক্তি চালাক হয়ে ওঠেন। ধ্যান করা বাদ দিয়ে তারা তাদের সময় কাটান শুধু যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে । এটা অনেকটা মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবনের মতো , যার চিকিৎসা করা খুব কঠিন। যদি বিশ্বাস ও প্রজ্ঞা সমতায় থাকে, তাহলে বিশ্বাসের যোগ্য বিষয়বস্তুতে, যেমন ত্রিরত্ন, কর্ম ও কর্মফলে তার বিশ্বাস থাকবে। সে বিশ্বাস করবে যে বুদ্ধের নির্দেশ অনুসারে ধ্যান করলে প্রতিভাগ নিমিত্ত ও ধ্যান লাভ করা সম্ভব ।

আবার যদি মনোযোগ প্রবল কিন্তু বীৰ্য্য বা প্রচেষ্টা দুর্বল হয়, তখন ভাবনাকারী ব্যক্তি অলস হয়ে উঠতে পারে। যদি বীৰ্য্য প্রবল কিন্তু মনোযোগ দুর্বল হয়, তখন সে চঞ্চল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যদি মনোযোগ ও প্রচেষ্টার সমতা থাকে, তাহলে সে অলসও হবে না, চঞ্চলও হবে না, এবং ধ্যান লাভ করতে সক্ষম হবে।

কোন ব্যক্তি শমথ ধ্যান পেতে ইচ্ছুক হলে তার বিশ্বাস প্রবল হলে ভালো হয়। যদি সে ভাবে, ‘প্রতিভাগ নিমিত্তে মনোযোগ দিলে আমি নিশ্চিত ধ্যান লাভ করতে সক্ষম হবো, ‘তখন সেই বিশ্বাসের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এবং প্রতিভাগ নিমিত্তে মনোযোগ দিয়ে সে নিশ্চিতই ধ্যান লাভ করবে। কারণ ধ্যান হচ্ছে মূলত মনোযোগের বিষয়।

বিদর্শন ভাবনাকারী ব্যক্তির প্রজ্ঞা প্রবল হওয়া ভালো, কারণ প্রজ্ঞা প্রবল হলে সে বিশ্লেষণপূর্বক অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম এই ত্রিলক্ষণকে বুঝতে এবং দেখতে সমর্থ হবে।

যখন মনোযোগ ও প্রজ্ঞার মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে, তখন লৌকিক ধ্যান অর্জন করা যায়। আবার বুদ্ধ যেভাবে শমথ ও বিদর্শন ভাবনা করতে শিখিয়েছেন। সেভাবে ধ্যান করলে লোকোত্তর ধ্যান অর্জন করা সম্ভব তখনই, যখন মনোযোগ ও প্রজ্ঞার মধ্যে সমতা বিরাজ করে।

স্মৃতি সবসময়ই দরকারী, কেননা এটি মনকে অতিরিক্ত বিশ্বাস, প্রচেষ্টা বা প্রজ্ঞার বশবর্তী হয়ে চঞ্চল হওয়া থেকে রক্ষা করে এবং অতিরিক্ত মনোযোগের ফলে অলস হওয়া থেকে রক্ষা করে। এটি বিশ্বাসের সাথে প্রজ্ঞা, মনোযোগের সাথে প্রচেষ্টা, এবং মনোযোগের সাথে প্রজ্ঞার মধ্যে সমতা আনে।



আচার বানাতে যেমন সব সময় লবণ লাগে, রাজার কাজকারবারে সবসময় যেমন মন্ত্রী লাগে, সেভাবেই সবসময় সর্বক্ষেত্রে স্মৃতি দরকারী। তাই প্রাচীন অর্থকথায় বলা হয়েছে যে, ভগবান বুদ্ধ বলেছেন, ‘যে কোন ধ্যানের বিষয়ে স্মৃতি সবসময়ই প্রয়োজন।’ কেন? কারণ, এটি হচ্ছে ভাবনাকারী মনের জন্য আশ্রয় ও রক্ষাকর্তা। স্মৃতি একটি আশ্রয়, কারণ এটি মনকে উচ্চস্তরে নিয়ে যায়, যেখানে মন কখনই আসে নি আগে। স্মৃতি ব্যতিরেকে মন কোন বিশেষ ও অসাধারণ স্তর লাভ করতে পারে না। স্মৃতি মনকে রক্ষা করে, ধ্যানের বিষয়বস্তুকে মন থেকে হারিয়ে যেতে দেয় না। তাই যারা এটাকে অন্তদৃষ্টি দিয়ে জানে, তাদের কাছে স্মৃতি যেন ধ্যানের বিষয়বস্তুকে রক্ষাকারী, সেই সাথে ভাবনাকারীর মনের রক্ষাকর্তাও বটে। স্মৃতি ছাড়া কোন ব্যক্তি তার মনকে উপরে তুলতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এ কারণেই বুদ্ধ এটাকে সর্বকাজে প্রয়োজনীয় বলেছেন।

কীভাবে আপনি সপ্ত বোধ্যঙ্গকে সমতায় আনবেন

শ্বাসপ্রশ্বাসে স্মৃতি রেখে কেউ যদি ধ্যান লাভ করতে চায়, তাহলে তার সপ্ত বোধ্যঙ্গের মাঝে সমতা বিধান করা জরুরি। এগুলো হচ্ছে :

  • ১. স্মৃতি: যা প্রতিভাগ নিমিত্তকে মনে রাখে এবং বার বার এটিকে লক্ষ করে।
  • ২. ধর্মবিচয় (ধর্মগুলো বিচার): যা প্রতিভাগ নিমিত্তকে তীক্ষ্ণ অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে বুঝে নেয়।
  • ৩. বীৰ্য্য (প্রচেষ্টা ): যা বোধ্যঙ্গগুলোকে একত্র করে এবং প্রতিভাগ নিমিত্তে তাদেরকে সমানভাবে জড়িয়ে রাখে; বিশেষত এটি নিজেকে ও সেই সাথে ধর্মবিচয়কে আরো প্রবল করে।
  • ৪. প্রীতি: প্রতিভাগ নিমিত্তকে জানার জন্য খুশি-ভাব।
  • ৫. প্রশান্তি: মনের ও মনের উপাদানগুলোর শান্ততা, যাদের বিষয়বস্তুই হচ্ছে প্রতিভাগ নিমিত্ত।
  • ৬. সমাধি: প্রতিভাগ নিমিত্তে মনের একাগ্রতা।
  • ৭. উপেক্ষা: মনের সমতা, যা প্রতিভাগ নিমিত্ত পেয়ে চঞ্চলও নয় , আবার তা থেকে নিজেকে সরিয়েও নেয় না।

ভাবনাকারীকে অবশ্যই এই সপ্ত বোধ্যঙ্গকে পরিপূর্ণ করতে হবে এবং সমতায় আনতে হবে। প্রচেষ্টা যথাযথ না হলে মন ধ্যানের বিষয়বস্তু তথা প্রতিভাগ নিমিত্ত থেকে দূরে সরে যায়। এক্ষেত্রে প্রশান্তি, মনোযোগ ও উপেক্ষাকে না বাড়িয়ে বাড়ানো দরকার ধর্মবিচয়, প্রচেষ্টা ও প্রীতিকে। এতে মন পুনরায় উজ্জীবিত হয়। যখন প্রচেষ্টা অত্যাধিক হয়, মন তখন চঞ্চল ও লক্ষ্যবস্তু থেকে বিক্ষিপ্ত হয় । তখন কিন্তু ভাবনাকারীর পক্ষে ধর্মবিচয়, প্রচেষ্টা ও প্রীতিকে বাড়ানো উচিত নয়, বরং তার উল্টোটা করা উচিত, অর্থাৎ এক্ষেত্রে বাড়ানো উচিত প্রশান্তি, মনোযোগ ও উপেক্ষাকে। এভাবে চঞ্চল ও বিক্ষিপ্ত মন বাধ্য হয় ও শান্ত হয়ে ওঠে। এভাবেই পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও সপ্ত বোধ্যঙ্গকে সমতায় আনতে হয়।

কীভাবে আপনি ধ্যান লাভ করবেন

পঞ্চ ইন্দ্রিয়-বিশ্বাস, প্রচেষ্টা, স্মৃতি, মনোযোগ ও প্রজ্ঞা- যখন যথেষ্ট পরিমাণে পরিপূর্ণতা লাভ করে , মনোযোগ তখন উপচার ধ্যান থেকে অর্পণা ধ্যানে পৌঁছে যায়। ধ্যানে পৌঁছলে আপনি নির্বিঘ্নে প্রতিভাগ নিমিত্তকে জানতে পারবেন। আপনি এভাবে থাকতে পারবেন কয়েক ঘন্টা, এমনকি সারারাত অথবা সারাটা দিন।



যখন মন এভাবে প্রতিভাগ নিমিত্তে সবসময় লেগে থাকে এক বা দুই ঘন্টা ধরে, আপনার তখন জানার চেষ্টা করা উচিত কোথায় মনোদ্বার (ভবাঙ্গ চিত্ত) অবস্থান করে। সেটাই মনোদ্বার-রূপ। ভবাঙ্গ চিত্ত হচ্ছে উজ্জ্বল ও দীপ্তিমান। অর্থকথায় এটাকে মনোদ্বার বলা হয়েছে। যদি আপনি অনেক অনেকবার চেষ্টা করতে থাকেন, তাহলে একসময় মনোদ্বার ও প্রতিভাগ নিমিত্তকে চিনতে পারবেন। এরপর আপনার ধ্যানের পাঁচটি অঙ্গকে একটি একটি করে চেনা দরকার। ক্রমাগত প্র্যাকটিসের ফলে আপনি ধ্যানাঙ্গগুলোকে একবারেই চিনে ফেলতে পারবেন। ধ্যানের পাঁচটি অঙ্গ হচ্ছে:

  • ১. বিতর্ক (উদ্দেশ্যমূলক চিন্তা): শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতিভাগ নিমিত্তে মনকে পরিচালনা করা ও সেখানে রাখা।
  • ২. বিচার (নিরবচ্ছিন্ন চিন্তা): শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতিভাগ নিমিত্তে মনকে ধরে রাখা ।
  • ৩. প্রীতি: শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতিভাগ নিমিত্তকে পছন্দ করা।
  • ৪. সুখ: শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতিভাগ নিমিত্ত সম্পর্কে সুখী মনোভাব।
  • ৫. একাগ্রতা: শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতিভাগ নিমিত্তের উপরে মনের একাগ্রতা।

ধ্যানের এই অঙ্গগুলোকেই সমন্বিতভাবে ধ্যান বলা হয়। ধ্যান প্র্যাকটিসের প্রাথমিক পর্যায়ে, আপনার দীর্ঘক্ষণ ধরে ধ্যানে প্রবেশের প্র্যাকটিস করা উচিত, ধ্যানাঙ্গগুলোকে জানার জন্য বেশি সময় ব্যয় করা উচিত নয়। ধ্যানের উপরে আপনার দক্ষতা (বেশী-ভাব) গড়ে তোলা উচিত।

পাঁচ প্রকার দক্ষতা আছে :

  • ১. ধ্যানের অঙ্গগুলোকে চেনার ক্ষমতা
  • ২. যখন খুশি ধ্যানে প্রবেশের দক্ষতা
  • ৩. যতক্ষণ ইচ্ছা ততক্ষণ ধ্যানে থাকার দক্ষতা
  • ৪. অমুক সময়ে ধ্যান থেকে উঠব- এরূপ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যথা সময়ে ধ্যান থেকে উঠার দক্ষতা
  • ৫. ধ্যানের অঙ্গগুলোকে পর্যালোচনা করার দক্ষতা

অঙ্গুত্তর নিকায়ের পব্বতেয়্যগাভী সূত্রে বুদ্ধ বলেছেন প্রথম ধ্যানে সুদক্ষ না হয়ে দ্বিতীয় ধ্যানে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত নয়। তিনি ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন যে যদি



[2 ধ্যানের অঙ্গগুলোকে চেনা ও পর্যলোচনা করাটা একই মনোদ্বার বীথিতে ঘটে থাকে। চেনার কাজটা ঘটে মনোদ্বারাবর্তন চিত্তের মাধ্যমে, এক্ষেত্রে যার বিষয়বস্তু হয় ধ্যানের পাঁচটি অঙ্গের যে কোন একটি অঙ্গ যেমন বিতর্ক। পর্যালোচনার কাজটা ঘটে চার, পাঁচ, ছয় বা সাতটা পর্যালোচনাকারী অনুরণন চিত্তে, যেই চিত্তগুলো মনের দরজার চেনার চিত্তের পরপরই উৎপন্ন হয়, যাদের বিষয়বস্তুও একই। বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য পঞ্চম দেশনা দেখুন।] (খুব শিঘ্রই পঞ্চম দেশনা পোষ্ট করা হবে। নিয়মিত চোখ রাখুন)

কেউ প্রথম ধ্যানে সর্বদিক দিয়ে সুদক্ষ না হয়ে উচ্চতর ধ্যানে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সে প্রথম ধ্যান হারাবে, সাথে সাথে উচ্চতর ধ্যানগুলোও লাভ করতে পারবে না। সে সবগুলো ধ্যানই হারিয়ে ফেলবে।

যখন আপনি প্রথম ধ্যানে সুদক্ষ হবেন, সবকিছু আপনার আয়ত্বে আসবে, তখন আপনি দ্বিতীয় ধ্যানে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা শুরু করে দিতে পারেন। আপনাকে প্রথম ধ্যানে ঢুকতে হবে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং প্রথম ধ্যানের দোষ পর্যালোচনা করতে হবে আর দ্বিতীয় ধ্যানের সুবিধাগুলো ভেবে দেখতে হবে। সেটা করতে হবে এভাবে- প্রথম ধ্যান হচ্ছে পঞ্চ নীবরণের খুব কাছাকাছি, বিতর্ক ও বিচার এই ধ্যানের অঙ্গগুলো স্কুল, তাই দ্বিতীয় ধ্যানের চেয়ে এটা অনেক কম শান্ত, দ্বিতীয় ধ্যানে এই ধ্যান অঙ্গগুলো নেই, তাই সেটি প্রথম ধ্যানের তুলনায় খুব শান্ত। অতএব, এই দুটি ধ্যানের অঙ্গগুলোর প্রতি কোন কামনা না রেখে, কেবল প্রীতি, সুখ ও একাগ্রতার জন্য আবার প্রতিভাগ নিমিত্তে মনোযোগ দিতে হবে। এভাবেই আপনি দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করতে পারবেন যেখানে থাকে শুধু তিনটি ধ্যানের অঙ্গ: প্রীতি, সুখ ও একাগ্রতা। এরপরে দ্বিতীয় ধ্যানে পাঁচ প্রকারে সুদক্ষ হওয়াটা আয়ত্ব করা উচিত।

যখন দ্বিতীয় ধ্যান আপনার আয়ত্বে আসবে , এবং তৃতীয় ধ্যান পেতে চাইবেন, তখন দ্বিতীয় ধ্যান থেকে বেরিয়ে এসে এর দোষগুলো পর্যালোচনা করতে হবে আর তৃতীয় ধ্যানের সুবিধাগুলো দেখতে হবে। অর্থাৎ, দ্বিতীয় ধ্যান হচ্ছে প্রথম ধ্যানের কাছাকাছি, আর এতে আছে প্রীতি নামক ধ্যান অঙ্গ যা স্থল। তাই এটি তৃতীয় ধ্যানের চেয়ে কম শান্ত, কেননা তৃতীয় ধ্যানে প্রীতি ধ্যানের অঙ্গটি নেই, তাই এটি আরো শান্ত। এভাবে মনে মনে তৃতীয় ধ্যান লাভের আকাঙ্খা নিয়ে এবার আপনার প্রতিভাগ নিমিত্তে মনোযোগ দেওয়া উচিত। এভাবে আপনি তৃতীয় ধ্যান লাভ করতে পারবেন, যেখানে আছে  কেবল সুখ ও একাগ্রতা। তৃতীয় ধ্যান লাভের পরে আপনার এই ধ্যানে পাঁচপ্রকারে সুদক্ষ হওয়াটা আয়ত্ব করা উচিত।

যখন এতে সফল হবেন এবং চতুর্থ ধ্যান পেতে চাইবেন, তখন আপনাকে তৃতীয় ধ্যান থেকে বের হয়ে এসে তৃতীয় ধ্যানের দোষগুলো পর্যালোচনা করতে হবে আর চতুর্থ ধ্যানের সুবিধাগুলো ভেবে দেখতে হবে। অর্থাৎ, এভাবে পর্যালোচনা করতে হবে, তৃতীয় ধ্যানে সুখ নামক ধ্যানাঙ্গ বা ধ্যানের উপাদান আছে, যা স্থুল, তাই এটি চতুর্থ ধ্যানের চেয়ে কম শান্ত। চতুর্থ ধ্যান লাভের ইচ্ছে নিয়ে এখন আপনার আবার প্রতিভাগ নিমিত্তে মনোযোগ দেওয়া উচিত। এভাবেই আপনি চতুর্থ ধ্যান লাভ করতে পারবেন, যাতে আছে কেবল উপেক্ষা ও একাগ্রতা। এরপর আপনার চতুর্থ ধ্যানে পাঁচপ্রকারে সুদক্ষ হওয়াটা আয়ত্ব করা উচিত।

চতুর্থ ধ্যান লাভের সাথে সাথে শ্বাস প্রশ্বাস সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে আনাপানস্মৃতির চতুর্থ ধাপ সম্পূর্ণ হয়:

  • ৪. “শ্বাসপ্রবাহ শান্ত করে আমি শ্বাস নেব”, এভাবে সে ভাবনা করে। “শ্বাসপ্রবাহ শান্ত করে আমি শ্বাস ফেলব”, এভাবে সে ভাবনা করে।’



এই ধাপটা শুরু হয় নিমিত্ত আবির্ভূত হওয়ার ঠিক আগে আগে। চারটি ধ্যানের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় ধ্যান যতই গভীর হতে থাকে, শ্বাসপ্রশ্বাস ততই শান্ত থেকে আরো শান্ত, সুক্ষ্ম থেকে আরো সুক্ষ্ম হয়ে ওঠে, যতক্ষণ না চতুর্থ ধ্যানে গিয়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

যখন ভাবনাকারী শ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্যানের মাধ্যমে চতুর্থ ধ্যানে পৌঁছে যান, আর পাঁচ প্রকারে সুদক্ষ হয়ে ওঠেন, মনোযোগের সেই আলোক উজ্জ্বল, দেদীপ্যমান হয়ে ওঠে, তখন তিনি ইচ্ছে করলে বিদর্শন ধ্যানে অগ্রসর হতে পারেন। অথবা তিনি শমথ ধ্যানে দক্ষতা লাভের জন্য অগ্রসর হতে পারেন। সেটাই পরবর্তী দেশনার বিষয়বস্তু- কীভাবে দশ কৃৎশ্নের মাধ্যমে শমথ ধ্যান করতে হয় ।

প্রশ্নোত্তর পর্ব-০১

  • প্রশ্ন ১.১: আনাপানস্মৃতির চারটি ধাপে কেমন করে আমরা বুঝবো কখন এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে যেতে হবে?

উত্তর ১.১: বুদ্ধ আনাপানস্মৃতি শিখিয়েছেন ধাপে ধাপে: দীর্ঘ শ্বাস, ছোট্ট শ্বাস, পুরো শ্বাস, আর সুক্ষ্ম শ্বাস, এগুলো শুধুমাত্র বুঝার সুবিধার জন্য। বাস্তবে ধ্যান করার সময় এই চারটি ধাপই একই সময়ে ঘটতে পারে। যেমন, শ্বাস যখন দীর্ঘ হয়, আমাদের পুরো শ্বাসটাকেই জানার চেষ্টা করা উচিত। যখন শ্বাস ছোট হয়, সংক্ষিপ্ত হয, তখনো আমাদের পুরো শ্বাসটাকে জানার চেষ্টা করা উচিত। এটা কেবল তখনই করা উচিত যখন আপনার মনোযোগের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, যখন আপনি আধা ঘন্টা মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন তখন। এরপর আপনি যদি পুরো দীর্ঘ শ্বাস ও ছোট্ট শ্বাসের উপরে মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন ঘন্টাখানিক, তাহলে শ্বাসপ্রশ্বাস এমনিতেই সুক্ষ্ম হয়ে যাবে, আর তখন আপনি সেই সুক্ষ্ম শ্বাসে মনোযোগ দিতে পারবেন। যদি শ্বাসপ্রশ্বাস সুক্ষ্ম না হয়, আপনার শুধুমাত্র শ্বাসপ্রশ্বাসে মনোযোগ দেওয়া উচিত। আপনি কখনই ইচ্ছে করে শ্বাসপ্রশ্বাসকে সুক্ষম করবেন না, অথবা দীর্ঘ বা ছোট্ট করবেন না। এভাবে, চারটি ধাপই একটা ধাপে এসে যায়। চতুর্থ ধাপে শ্বাসপ্রশ্বাস কেবল সুক্ষ্ম হয়ে যায়, পুরোপুরি বন্ধ হয় না। শ্বাসপ্রশ্বাস পুরোপুরি থেমে যায় কেবল চতুর্থ ধ্যানে। এটাই সবচেয়ে সুক্ষ্মতম ধাপ।

  • প্রশ্ন ১.২: ধ্যানে নিমিত্ত থাকার প্রয়োজন আছে কি?

উত্তর: কিছু কিছু ধ্যান আছে যেমন আনাপান, কৃৎস্ন ধ্যান ও অশুভ ধ্যানে একটা নিমিত্ত প্রয়োজন। কিন্তু অন্যান্য ধ্যানের বিষয় যেমন বুদ্ধানুস্মৃতিতে ধ্যান লাভের জন্য নিমিত্তের প্রয়োজন নেই। মৈত্রী ভাবনায় সীমা ভেঙে ফেলাকে বলা হয় নিমিত্ত।

  • প্রশ্ন ১.৩: কেউ কেউ বলে যে শ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্যানের সময়ে তাদের আত্মা দেহের বাইরে চলে যায়। এটা কি সত্যি, নাকি তারা ভুল পথে আছে?

উত্তর ১.৩: একাগ্র মন স্বাভাবিকভাবেই নিমিত্ত সৃষ্টি করে। যখন মনোযোগ গভীর, প্রবল ও শক্তিশালী হয়, বিভিন্ন সংজ্ঞার কারণে বিভিন্ন ধরনের নিমিত্ত হাজির হয়। যেমন, যদি আপনি নিমিত্তকে দীর্ঘ চান, এটি দীর্ঘ হবে; যদি আপনি এটাকে ছোট চান, এটি ছোট হবে; যদি আপনি গোল চান, এটি গোল হবে, যদি আপনি লাল চান, এটি লাল হয়ে যাবে। অতএব, শ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্যানে নানাধরনের সংজ্ঞার উৎপত্তি হতে পারে। আপনি নিজেকে দেহের বাইরে দেখতে পান। এটা মনের সৃষ্টি মাত্র, আত্মার কারণে নয়। এটা কোন সমস্যা নয়। এটাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতি মনোযোগী হোন।

একমাত্র যখন আপনি ভেতরের ও বাইরের পরমার্থ নামরূপকে যথাযথভাবে চিনবেন, তখন আপনি আত্মার সমস্যার সমাধান করতে পারবেন: আপনি তখন কোথাও আত্মাকে খুঁজে পাবেন না। তাই আপনাকে দেহমনের বাঁধনকে ভেঙে ভেঙে পরম দেহ মনকে দেখতে হবে, উপলদ্ধি করতে হবে।

‘নানাধাতুযো বিনিভুজিত্বা ঘনবিনিভোগে কতে অনত্তলঙ্খনং যাথাবসরসতো উপঠাতি’:

যখন আমরা এই ঘন বাঁধনকে ভেঙে ফেলি, অনাত্ম সংজ্ঞার উদয় হয়। দেহ ও মনের নিবিড় বাঁধনের কারণেই আত্মার ধারণার জন্ম হয়।



দেহের নিবিড়তাকে ভাঙতে গিয়ে আপনাকে প্রথমে রূপ কলাপকে (ক্ষুদ্র কণা) চিনতে হবে। এরপরে চিনতে হবে বিভিন্ন ধরনের পরমার্থ রূপকে, যেগুলো প্রত্যেকটি রূপ কলাপে কমপক্ষে আটটি করে থাকে। এটা করা ব্যতীত আত্মার ধারণা বিলুপ্ত হবে না।

একইভাবে, মনের নিবিড়তাকে ভাঙা ব্যতীত আত্মার ধারণাটা চলে যাবে না। উদাহরণস্বরূপ, যখন মন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, আপনি হয়তো মনে করতে পারেন, এই ভ্রমণরত মনটাই হচ্ছে আত্মা। আরেকটা উদাহরণ হচ্ছে বিসঙ্খারগতং চিত্ত। এখানে বিসঙ্খার মানে হচ্ছে ‘সংস্কারবিহীন’ ,অর্থাৎ নির্বাণ। সংস্কারগুলো হচ্ছে নাম, রূপ ও তাদের কারণগুলো। নির্বাণের কোন সংস্কার নেই, কিন্তু নির্বাণকে দেখার কাজে চেতনাজনিত সংস্কারের প্রয়োজন। বুদ্ধের ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে অহত্ব ফল চিত্ত ও তার সাথে উৎপন্ন চৈতসিকগুলো। যদি এটা প্রথম ধ্যান অহত্ব ফলচিত্ত হয়, তাহলে সেখানে থাকে ৩৭ টি চিত্তসংস্কার। যারা এখনো মার্গ জ্ঞান, ফল জ্ঞান, ও বিদর্শন জ্ঞান লাভ করেন নি, অথবা যারা এখনো মনের নিবিড়তাকে ভেঙে ফেলেননি, তারা চিত্তকেই তাদের আত্মা বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু মনের নিবিড়তাকে ভেঙে ভেঙে দেখলে তারা দেখবেন যে চিত্ত ও তার চৈতসিকগুলো দ্রুতগতিতে উৎপন্ন ও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অনিত্যের ধারণার সাথে আসবে অনাত্মর ধারণা। মেঘিয় সুত্রে বুদ্ধ বলেছেন: অনিচ্চসঞিঞনো মেঘিয় অনত্তসঞঞণ্থতি’। ‘যাদের অনিত্য দেখার মত অন্তদৃষ্টি-জ্ঞান খুব তীক্ষ্ণ, তাদের কাছে অনাত্ম দেখার মত অন্তদৃষ্টি- জ্ঞান পরিষ্কারভাবে উৎপন্ন হয়।

  • প্রশ্ন ১.৪: [আনাপানা] নিমিত্ত কোথেকে আসে? এটা কী কারণে উৎপন্ন হয়?

উত্তর ১.৪: বেশির ভাগ মনের অবস্থাগুলো শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে মনের প্রতিক্রিয়ার কারণে উৎপন্ন হয়। সত্যিকারের আনাপান- নিমিত্ত উৎপন্ন হয় শ্বাসপ্রশ্বাস থেকে। তবে প্রত্যেক মনের অবস্থাই নিমিত্ত উৎপন্ন করে না। কেবল গভীরভাবে একাগ্র মনই নিমিত্ত উৎপন্ন করে। অতএব, গভীর ও একাগ্র মনের শ্বাসপ্রশ্বাসে আনাপান নিমিত্ত আবির্ভূত হয়। যদি নিমিত্তটি নাকের ডগা থেকে দূরে দেখা যায়, তাহলে এটি সত্যিকারের নিমিত্ত নয়। একাগ্রতার কারণে নিমিত্ত উৎপন্ন হতে পারে, কিন্তু সেটা সবসময় সত্যিকারের নিমিত্ত হয় না। যদি এই নিমিত্তের মাধ্যমে ধ্যান উৎপন্ন হয়, তখন আমরা সেটাকে আনাপান নিমিত্ত বলি। কিন্তু যদি এটি ধ্যান উৎপন্ন না করে, তাহলে সেটা সত্যিকারের আনাপান নিমিত্ত নয়। যদি আপনি সেই নিমিত্তে মনোযোগ দেন, তাহলে ধ্যান উৎপন্ন হবে না। সাধারণত এতে মনোযোগটা তীব্র ও শক্তিশালী হয় না। যদি আপনি এমন নিমিত্ত নিয়ে ধ্যান করতে থাকেন, সেটা শীঘ্রই হারিয়ে যাবে।

  • প্রশ্ন ১.৫: বিশুদ্ধির সাতটি ধাপ এবং ষোলটি বিদর্শন জ্ঞান কী কী?

উত্তর ১.৫: বিশুদ্ধির সাতটি ধাপ হচ্ছে :

  • ১. শীল বিশুদ্ধি,
  • ২. চিত্ত বিশুদ্ধি,
  • ৩. দৃষ্টি বিশুদ্ধি,
  • ৪. কথা-উত্তরণ বিশুদ্ধি,
  • ৫. মার্গ-অমার্গ জ্ঞানদর্শন বিশুদ্ধি,
  • ৬. প্রতিপদ জ্ঞানদর্শন বিশুদ্ধি,
  • ৭. জ্ঞানদর্শন বিশুদ্ধি।

ষোলটি বিদর্শন জ্ঞান হচ্ছে:

  • ১. নাম রূপ পরিচ্ছেদ জ্ঞান,
  • ২. প্রত্যয় পরিগ্রহ জ্ঞান,
  • ৩. সংমৰ্শন জ্ঞান,
  • ৪. উদয়-বিলয় জ্ঞান,
  • ৫. ভঙ্গ জ্ঞান,
  • ৬. ভয় জ্ঞান,
  • ৭. আদীনব জ্ঞান,
  • ৮. নির্বেদ জ্ঞান,
  • ৯. মুক্তিকাম্যতা জ্ঞান,
  • ১০. প্রতিসংখ্যা জ্ঞান,
  • ১১. সংস্কারোপেক্ষা জ্ঞান
  • ১২. অনুলোম জ্ঞান,
  • ১৩. গোত্রভু জ্ঞান,
  • ১৪. মার্গ জ্ঞান,
  • ১৫. ফল জ্ঞান,
  • ১৬. প্রত্যবেক্ষণ জ্ঞান।



এখন আপনি ষোলটি বিদরশন জ্ঞানের নাম জানেন, ভালো কথা, কিন্তু আপনি কি সেগুলো নিজে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন? না। এজন্যই শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান যথেষ্ট নয়। এগুলোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই প্রবল প্রচেষ্টা নিয়ে ধ্যানসাধনা চালিয়ে যেতে হবে। [সম্পাদকের বক্তব্য; এই দেশনার পরে পা-অক সেয়াদ পঞ্চনীবরণের উপরে। নিম্নোক্ত কথাগুলো বলেন।]

এখন আমি আপনাদেরকে সংক্ষেপে পাঁচটি নীবরণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে দিতে চাই। প্রথম নীবরণ হচ্ছে ইন্দ্রিয় সুখ কামনা (কামচ্ছন্দ)। এটি হচ্ছে ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি আসক্তি। এটি হচ্ছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু পাওয়ার কামনা। উদাহরণস্বরূপ, আপনি আপনার কুটির অথবা রুমের প্রতি আসক্ত হতে পারেন। ধ্যানের সময়ে আপনি চিন্তা করতে পারেন, ‘আহা, আমার কুটিরটা সুন্দর হলে খুব ভালো হতো।’ অথবা আপনি ভাবতে পারেন, ‘আহা, পুরো রুমটাই যদি আমার হতো, তাহলে ভালো হতো।’ ইন্দ্রিয় সুখ কামনার চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে থাকলে আপনি আপনার ধ্যানের বিষয়বস্তুতে ভালোভাবে মনোযোগ দিতে পারবেন না। ইন্দ্রিয় সুখ কামনার চিন্তাগুলো থামাতে হলে আপনার অবশ্যই তীক্ষ্ণ স্মৃতি এবং প্রচন্ড প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দ্বিতীয় নীবরণ হচ্ছে ধ্বংসাত্মক চিন্তা (ব্যাপাদ)। এটি হচ্ছে ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি ঘৃণা অসন্তোষ। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার পাশে বসা কোন একজন ধ্যান চলাকালীন সময়ে তার চীবর দিয়ে খসখস শব্দ করেন, আপনি তাতে ক্ষুদ্ধ হয়ে ভাবতে পারেন, ‘আহা, এই লোকটা এত শব্দ করছে কেন? ‘যদি আপনার মনটা ঘৃণা বা অসন্তোষ দিয়ে জর্জরিত থাকে, তখনও আপনি ধ্যানের বিষয়বস্তুতে মনোযোগ দিতে পারবেন না। তৃতীয় নীবরণ হচ্ছে আলস্য এবং জড়তা (থিন-মিদ্ধ)। যদি মনটা দুর্বল হয়, অথবা ধ্যানের বিষয়বস্তুতে আগ্রহী না হয়, তাহলে আলস্য এবং জড়তা আসতে পারে। মাঝে মাঝে অবশ্য ক্লান্তি বা বিশ্রামের অভাবেও তন্দ্রা আসতে পারে। চতুর্থ নীবরণ হচ্ছে চঞ্চলতা এবং অনুতাপ (ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য)। যদি আপনার মনটা চঞ্চল হয়, তখন সেটা যেন ঢিল ছুঁড়ে মারা একটা ছাইয়ের স্তুপ, যেখানে ছাইগুলো চারদিকে উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। একইভাবে, চঞ্চলতা থাকলে মনটাও বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ধ্যান করার সময় আপনি কখনোই মনকে বিশ্রাম নিতে দেবেন না এবং মনকে ধ্যানের বিষয়বস্তু হতে অন্যকোথাও চলে যেতে দেবেন না। যদি দেন, তো চঞ্চলতা আসবে। অনুতাপ হচ্ছে অতীতের খারাপ কাজ করা হয়েছে। এবং ভালো কাজগুলো করা হয় নি, তার জন্য আফসোস করা। এখানেও আপনাকে তীক্ষ্ণ স্মৃতি রাখতে হবে এবং চঞ্চলতা ও অনুতাপ যাতে না আসে তার জন্য কঠিন প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

পঞ্চম নীবরণ হচ্ছে কোনকিছুর সত্যতা সম্বন্ধে সংশয় (বিচিকিচ্ছা)। এটা হচ্ছে :

  • ১. বুদ্ধ সম্পর্কে সন্দেহ
  • ২. ধর্ম সম্পর্কে সন্দেহ
  • ৩. সংঘ সম্পর্কে সন্দেহ
  • ৪. ত্রিশিক্ষা, যথা- শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে সন্দেহ,
  • ৫. অতীত পঞ্চস্কন্ধ সম্পর্কে সন্দেহ,
  • ৬. ভবিষ্যৎ পঞ্চস্কন্ধ সম্পর্কে সন্দেহ,
  • ৭. একই সাথে অতীত ও ভবিষ্যৎ পঞ্চস্কন্ধ সম্পর্কে সন্দেহ,
  • ৮. প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি সম্পর্কে সন্দেহ।

সমাধি শিক্ষা সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে আপনি ভালোমতো ধ্যান করতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ , আপনি হয়তো ভাবতে পারেন: ‘আনাপানস্মৃতির মাধ্যমে কি ধ্যান লাভ করা সম্ভব? আনাপান নিমিত্তে মনোযোগ দিয়ে কি ধ্যান পাওয়া যাবে? ‘ এই পাঁচটি নীবরণ হচ্ছে ধ্যান সমাধির অন্তরায়।

দেশকঃ পা-অক সেয়াদ

বাংলা অনুবাদঃ জ্ঞান শান্ত ভিক্ষু

আরো পড়ুন>>

বৌদ্ধ বার্তা

শেয়ার করে সবাইকে পড়ার সুযোগ দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!