ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া: সংগীতের মহান গুরু, এক অভিজ্ঞানী শিল্পী

স্মরণীয় বরণীয় || বৌদ্ধবার্তা

ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া: কিছু মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন, যাদের জীবন ও কর্ম আলোকিত করে যায় আমাদের চারপাশ। তাঁদের মেধা, মনন এবং প্রজ্ঞা যেন এক অপূর্ব সৃষ্টি, যা কেবল তাঁদের হাতেই সম্ভব। তেমনই একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন আমাদের ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া। সংগীতের এই মহান গুরুর প্রতিভার আলোয় শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সমগ্র উপমহাদেশও আলোকিত হয়েছে। সৃষ্টির নীরবতা এবং নিভৃত জীবন যাপন করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। এবং অবশেষে, সরকারও তাঁকে ভুলে যায়নি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২০২৫ সালের একুশে পদক প্রাপ্ত ১৪ বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে রয়েছেন ফটিকছড়ির এই কৃতিসন্তান। ৬ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় চট্টগ্রামে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।

তবে, নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর কীর্তিগাথা তুলে ধরাটা কি আমাদের দায়িত্ব নয়? এইসব গুণী মানুষ যাতে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে না যান, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।

১৯৩৬ সালে ফটিকছড়ির আবদুল্লাপুর গ্রামে সবুজ ছায়াঘেরা পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া। তাঁর বাবা ছিলেন নিকুঞ্জ বিহারী বড়ুয়া এবং মা বিরলা বালা বড়ুয়া। শৈশব থেকেই সংগীতের প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ জন্ম নেয়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুতে তাঁর জীবনও এক নতুন মোড় নেয়। ১৫ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং ওস্তাদ নাটু ঘোষের কাছে সংগীতশিক্ষা শুরু করেন। পরে, তিনি বিশিষ্ট ধ্রুপদী গায়ক অনিল ঘোষ এবং সঙ্গীতাচার্য প্রফুল্ল কুমার সেনের কাছে আরও গভীরভাবে সংগীত শেখেন। অল-ইন্ডিয়া মিউজিক কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে ১৯৬৫ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।

চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টের তৎকালীন সিনিয়র মেডিকেল অফিসার কামাল এ খান এই প্রতিভাবান শিল্পীকে চিনতে ভুল করেননি। তিনি ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়াকে চট্টগ্রামের সুধী সমাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর, চট্টগ্রাম বেতারের মাধ্যমে তিনি সংগীতের সুধা ছড়িয়ে দিতে থাকেন।

আর্য সংগীত সমিতি তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে ‘সুরেন্দ্র সংগীত বিদ্যাপীঠ’-এর শিক্ষক হিসেবে। দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে চট্টগ্রামে শাস্ত্রীয় সংগীতের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর হাতে গড়া শিক্ষার্থীরা এখন দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংগীতের চর্চা করছেন। ১৯৮৮ সালে অবসর নেওয়ার পরেও, তাঁর সংগীতের প্রতি ভালোবাসা কমেনি। শিক্ষার্থীদের অনুরোধে তিনি মোমিন রোডে শুরু করেন ‘সুর সপ্তক সংগীত বিদ্যাপীঠ’, যা আজও সংগীত শিক্ষার্থীদের জন্য এক অমূল্য খনি।

ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়ার প্রতিভার আরেক নিদর্শন ছিল সংগীতভিত্তিক নাটক ‘সুরের সন্ধান’, যা পরপর দুবার মঞ্চস্থ হয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। এছাড়া, তাঁর লেখা ‘আরোহ-আবরোহ’ বইটি আজও সংগীত শিক্ষার্থীদের জন্য অমূল্য সম্পদ।

২০০১ সালের ৯ আগস্ট, তিনি চিরতরে চলে যান। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর সংগীতের গভীরতা, সুরের মায়া। এক সাদামাটা গ্রামের ছেলেটি, যিনি একদিন দেশের এত বড় সম্মানে ভূষিত হবেন, সংগীতের মাধ্যমে মানুষের অনুভূতিকে প্রকাশ করবেন, তা কে জানত?

তাঁর নামে ফটিকছড়ির কোনো সড়ক বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হলে তবেই তাঁর প্রতি এক যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। কিন্তু, তাঁর সৃষ্টি চিরকাল আমাদের হৃদয়ে অমলিন হয়ে থাকবে। মরণোত্তর একুশে পদক প্রাপ্ত এই সংগীত গুরুকে জানাই আমাদের অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা।

শেয়ার করুন।

শেয়ার করে সবাইকে পড়ার সুযোগ দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!