বড়ুয়া জাতি: বঙ্গীয় বৌদ্ধদের মধ্যে অধিকাংশের উপাধি বডুয়া হলেও আরো কয়েকটি উপাধির প্রচলন দেখা যায়। যেমন-চৌধুরী, তালুকদার, মুৎসুদ্দী, সরকার, সিকদার, সিংহ, হাজারী ইত্যাদি। তবে সংখ্যায় বড়ুয়া উপাধি ব্যবহারকারী হল সর্বাধিক। অন্যান্য উপাধিগুলোর চেয়ে বডুয়া উপাধিটি হল খুবই প্রাচীন, ইতিহাস সিদ্ধ ও গর্বের। বডুয়া ছাড়া বাকী উপাধিগুলোর কয়েকটা (চৌধুরী, তালুকদার, মুৎসুদ্দী, হাজারী, সরকার প্রভৃতি) তেমন সুপ্রাচীন নয় এবং বড়ুয়া উপাধির মত সমুজ্জ্বলও নয়। সেগুলি হল উপরস্থ কর্তা ব্যক্তিদের সন্তুষ্ট করে প্রাপ্ত সম্মানের মত বা প্রভূ সেবার পুরস্কারের মত । যার সূচনা হয়েছিল ইংরেজ শাসনকাল হতে। অনেকে নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে অনভিজ্ঞতার কারণে বা সচেতন না থাকার কারণে বড়ুয়া উপাধির তুলনায় অন্যান্য অভিধা সমূহকে অধিকতর মহান মনে করে এবং তারা নিজেরাও এ উপাধিগুলো ব্যবহার করে গর্বানুভব করে থাকে।
বাস্তবিক পক্ষে বডুয়া অভিধাটি এসেছে পালি ভাষার ‘বজ্জী’ (বৃজি) শব্দ হতে। যার অর্থ হল শ্রেষ্ঠ জাতি। বজ্জী নামে বুদ্ধ কালীন সময়ে প্রাচীন এক সম্প্রদায় ছিল। তাঁদের পৃথক রাজ্য ছিল। তাঁরা ছিলেন গণতান্ত্রিক (Democracy) শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তক। পৃথিবীর প্রথম গণতন্ত্র বজ্জীদের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছে বলে ইতিহাস রয়েছে। ভগবান বুদ্ধও তাঁর সঙ্ঘে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন। প্রাচীন ভারতের বজ্জীদের কাছ হতেই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তা আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থারূপে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ অনুসরণ করছে। বজ্জীরা ছিলেন প্রাচীন ভারতের বৈশালীর অধিবাসী। বজ্জীরা সকলে ছিলেন তথাগত বুদ্ধের অনুগামী এবং তাঁরা ছিলেন অতীব সুশৃঙ্খল, ঐক্যবদ্ধ, সভ্য ও শিক্ষিত। ভগবান বুদ্ধ বৈশালীতে পঞ্চম ও পঁয়তাল্লিশ বর্ষাবাস অতিবাহিত করেছিলেন। তিনি অনেক মূলবান ধম্মদেশনা করেছিলেন বৈশালীতে। মহাপরিনির্বাণের ঘোষণাও তিনি বৈশালীতেই করেছিলেন। বজ্জী সম্প্রদায়কে বুদ্ধ দেবতার সাথে তুলনা করেছিলেন। বুদ্ধ যে সপ্ত অপরিহানীয় বা অপরাজেয় ধম্মের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন, সে সপ্ত অপরিহানীয় ধম্মের সবটাই বজ্জীরা নিষ্ঠার সাথে অনুশীলন করতেন। এজন্য তৎকালীন ভারতবর্ষে বজ্জীরা উন্নত, সমৃদ্ধ ও অপরাজেয় জাতির শিরোপা লাভ করেছিলেন। বুদ্ধকালীন ভারতের বজ্জীগণরাজ্য ছিল ষোড়শ মহাজনপদের অন্যতম খ্যাতি প্রাপ্ত জনপদ।
বর্তমানের বডুয়ারা হলেন প্রাচীন বজ্জী বংশেরই বংশধর। বজ্জী হতে ‘বডুয়া’ শব্দ এসেছে। মগধে বৌদ্ধদের উপর আক্রমণের সময় অনেক বৌদ্ধ মাটির (স্থানের) মায়া ত্যাগ করতে না পারায় তাঁরা ব্রাহ্মণ্য দাসত্ব গ্রহণ করে ধম্ম ত্যাগের মাধ্যমে শুদ্রত্বের পর্যায়ে মানবেতর জীবন গ্রহণ করেছিলেন এবং যাঁরা ধম্ম ত্যাগে রাজী হননি, তাঁরা মাটি ত্যাগ করে আসাম হয়ে স্থানান্তর হতে হতে চট্টগ্রামে এসে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছিলেন।
সুতরাং বড়ুয়াদের অতীত ইতিহাস দেখলে প্রমাণিত হয়, ভারতবর্ষে যাঁরা বুদ্ধকালীন সময় হতে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত ও উত্থান-পতনের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন এবং বিভিন্ন স্থান ত্যাগ করে প্রাণান্তেও ধম্ম ত্যাগ করেননি, তাঁদের মধ্যে বডুয়া জাতি হলেন অন্যতম। অতীতে বডুয়াদের পূর্ব পূরুষ বজ্জীরা ছিলেন শাসক গোষ্ঠী, প্রজা বা সেবক গোষ্ঠী নন।
আমাদেরই একটি অংশ ভারতের আসামে ব্রাহ্মণ্য বশ্যতা স্বীকার করে নিলেও তাঁরা কিন্তু নিজেদের ‘বড়ুয়া’ পদবী ত্যাগ করেননি। বর্তমানে তাঁরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারী হলেও তাঁদের গর্বিত পদবী ‘বরুয়া’ টিকিয়ে রেখেছেন।
এদিক দিয়ে বিচার করলে ‘বডুয়া’ পদবী হল অনেক গৌরবের ও সম্মানের। কিন্তু আমাদের এখনকার প্রজন্মের অনেকেই বড়ুয়াদের অতীত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন নয়। এজন্য আমাদের অনেকে ‘বডুয়া’ পদবীর চেয়ে অন্যান্য চৌধুরী, মুৎসুদ্দী, তালুকদার ইত্যাদি অপরের অধীনস্থ বা দাসত্ব সূচক পদবী সমূহ ব্যবহারেই অধিক গর্বিত মনে করে থাকেন।
বঙ্গীয় বৌদ্ধদের গর্বিত সন্তান লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হতে এশিয়ার প্রথম ডি. লিট উপাধি প্রাপ্ত ভারততত্ববিধ ড. বেণী মাধব বড়ুয়া (১৮৮৮-১৯৪৮) তিনি তাঁর পারিবারিক ‘তালুকদার’ উপাধি ত্যাগ করে ‘বডুয়া’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। কেননা তিনি ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ও পারঙ্গম ছিলেন। বডুয়া উপাধি ধারণ করেই তিনি অধিকতর গর্বিত মনে করতেন।
এখন অতীব পরিতাপের সাথে বলতে হয় যে, আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই অতীত সম্পর্কে চর্চা করেনা। নিজেরাও পড়াশুনা করেনা এবং বিজ্ঞজনদের থেকে কাছ থেকেও জানার চেষ্টা করেনা। তাই যে যা বলে সেদিকেই শুনে শুনে ধাবিত হয়। নিজেদের অতীত গৌরবের ইতিহাস মুচে অনেক বডুয়া সন্তান এখন ‘মার্মাগ্রী’ লিখতে উৎসাহিত হচ্ছে এক তান্ত্রিক গুরুর ফাঁদে পড়ে। সে তান্ত্রিক গুরু সুকৌশলে বডুযাদের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে বডুয়া পদবী পর্যন্ত মুচে ফেলার জন্য উৎসাহিত করেছেন। তাঁর অন্ধ অনুসারীরাও বুদ্ধের প্রশংসিত সুমহান বড়ুয়া (বজ্জী) উপাধি, যা আড়াই হাজার বছরাধিকাল হতে চলে আসছে, তাকে ত্যাগ করতে একটু দ্বিধাবোধ পর্যন্ত করছেনা। কিরকম অন্ধ গুরুভক্তি হলে এবং কিরকম আত্মঘাতী হলে নিজেদের এরকম গর্বিত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মূলোচ্ছেদ করতে পারে, তা ভাবতেও অবাক লাগে! আমাদের মত এরকম ছন্নছাড়া, উদাসীন, পরপদলেহী জনগোষ্ঠী আর আছে কিনা আমার জানা নাই। এগুলি হচ্ছে একটা সম্প্রদায়ের ইতিহাসকে এবং ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্নকেও মুচে ফেলা। কিরকম আত্মঘাতী ও হীনমন্যতা সম্পন্ন জাতি আমরা এতেই প্রমাণিত হয়। আমাদের মনে হয় এরা ভবিষ্যতে নামের আগে আরব্য সংস্কৃতির ‘মো.’ লিখতেও দ্বিধা করবেনা। আলামতে তাই মনে হচ্ছে।
আচার-ব্যবহারে, খাদ্যাভ্যাসে, চলা-ফেরা ও কথাবার্তায় এমনিতেই নিজেদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে ত্যাগ করে আমরা আরব্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে রয়েছি। তারা আমাদেরকে প্রায় গ্রাস করে নিয়েছে। নিজেরা এভাবে উদাসীন হলে অবশিষ্টও গ্রাস করতে বেশীদিন আর থাকবেনা।
ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু