কোরিয়ায় বিশ্বের বৃহত্তম বৌদ্ধ বিশ্বকোষ সম্পন্ন

কোরিয়ায় বৌদ্ধ বিশ্বকোষ: সিওলে অবস্থিত কাসান বৌদ্ধ সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট মঙ্গলবার বিশ্বের বৃহত্তম বৌদ্ধ বিশ্বকোষ, ‘কাসান বৌদ্ধ বিশ্বকোষ’ সম্পূর্ণ হয়েছে বলে ঘোষণা করেছে। এই বছর চূড়ান্ত খণ্ড ১৭-২০ প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ৪২ বছরের প্রকল্পটি সমাপ্তি হল। কোরিয়ায় বৌদ্ধ ভিক্ষু ভদন্ত জিক ওয়ান বৌদ্ধধর্মের বিস্তৃত ইতিহাসকে যাতে স্ট্যান্ডার্ড কোরিয়ান ভাষায় সহজে পাওয়া যায় এমন করার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই প্রকল্পটি শুরু করেছিলেন।

১৯৮২ সালের মে মাসে, পঞ্চাশ বছর বয়সী ভদন্ত জিকওয়ান কোরিয়ায় সিওলের বুখান পর্বতের নিকটে অবস্থিত গায়নগোক বৌদ্ধ মন্দিরে অবস্থান করার সময় তার মাথায় এই চিন্তা মাথা আসে। উল্লেখ্য ভদন্ত জিকওয়ান কোরিয়ায় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ শিক্ষার ডিন, বৌদ্ধধর্মের বিস্তৃত ইতিহাস সাধারণ মানুষের কাছে সহজে বোঝার উপযোগী করে তোলার লক্ষ্যে একটি বিশ্বকোষ রচনার মহান মিশনে জড়িয়ে পড়েন ভদান্ত জিকওয়ান।

ভিক্ষু ওয়ান বলেন “এতদিন পরে, আমি একটি বিশ্বকোষ লিখতে শুরু করছি, আশা করি, অষ্ট রক্ষাকর্তা আমার পাশে থাকবেন এবং বুদ্ধের জ্ঞান প্রকাশিত হবে।”

এই প্রার্থনার মধ্য দিয়ে একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের সূচনা করে। ১৯৯১ সালে, ভদন্ত জিকওয়ান ‘কাসান বৌদ্ধ সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৫ সালে, ভদান্ত জিকওয়ান কোরিয়ার বৃহত্তম বৌদ্ধধর্মীয় সম্প্রদায় ‘জোগয়ে অর্ডার’ এর প্রধান হয়ে ওঠেন। একাকী গবেষণা থেকে শুরু হয়ে প্রকল্পটি তিন দশকে ১৫,০০০ জন কর্মী জড়িয়ে একটি বৃহৎ আকারের প্রকল্পে রূপান্তরিত হয়। প্রথম দুটি খণ্ড সম্পূর্ণ করতেই দশক লেগে গেলেও, পরবর্তী খণ্ডগুলো প্রতি বছর প্রকাশিত হতে থাকে। পরিতাপের বিষয় ২০১২ সালে ১৩তম খণ্ড প্রকাশের কিছুকাল পরেই ভদান্ত জিকওয়ান মারা যান। এই মহৎ কাজের পরিসমাপ্তি তিনি করে যেতে পারেননি। ভদন্ত জিকওয়ান তার মৃত্যুর ছয় মাস আগে অনুরোধ করেছিলেন, ”এক সাথে কাজ করুন এবং কাজটি শেষ করুন।”

‘কাসান বৌদ্ধ বিশ্বকোষ’ বিশ্বের সবচেয়ে বিস্তৃত বৌদ্ধ বিশ্বকোষ হওয়ার দাবী রাখে, এতে প্রায় ১২০,০০০টি এন্ট্রি এবং ২৬৬,০০০টি পৃষ্ঠা রয়েছে। এটি একাধারে একটি ধর্মগ্রন্থ, দার্শনিক গ্রন্থ, ঐতিহাসিক উপকরণ এবং আরও অনেক কিছু থেকে প্রধান ধারণাগুলিকে ধারণ করে। সবগুলিই প্রতিদিনের কোরিয়ান ভাষায় বর্ণানুক্রমিকভাবে সাজানো। বিশ্বকোষটি কোরিয়ায় বৌদ্ধধর্মের সাংস্কৃতিক অভিযোজনে বিশেষ গুরুত্ব দেয়, ৩০ শতাংশ এন্ট্রি কোরিয়ান বৌদ্ধধর্মের জন্য নিবেদিত।

চতুর্থ শতাব্দীতে কোরিয়ায় বৌদ্ধধর্মের প্রচলনের পর থেকে, এই ধর্মটি স্থানীয় লোককাহিনী, চিন্তাধারা, শৈল্পিক আদর্শ ইত্যাদিকে এর সাথে মিশিয়ে নিয়েছে। বিশ্বকোষটি তুলনামূলক অধ্যয়নের প্রতি আগ্রহকে তুলে ধরে, চীনা সাহিত্যি, তিব্বতি এবং সংস্কৃত ভাষায় মূল উৎসের তথ্যসূত্র অন্তর্ভুক্ত করেছে এখানে।

চতুর্থ শতাব্দীতে কোরিয়ায় বৌদ্ধধর্মের প্রচলনের পর থেকে, এই ধর্মটি কোরিয়ানদের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে। এ কারণেই, ভদান্ত জিকওয়অন ১৩তম খণ্ডের ভূমিকায় লিখেছেন, “কোরিয়ার বৌদ্ধ ইতিহাসের একটি বিশ্বকোষ সম্পাদনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই কাজের মাধ্যমে আমরা এই জাতির আধ্যাত্মিক ইতিহাসের গৌরব জাগিয়ে তোলার প্রত্যাশা করছি।”

‘কাসান বৌদ্ধ বিশ্বকোষ’ কোরিয়ার পাবলিক লাইব্রেরি ও জাদুঘরে পাওয়া যাবে, সেইসাথে বিদেশের নির্বাচিত কলেজেও পাওয়া যাবে। গবেষকদের কাছে যেন সহজে এটি পৌছে যায় সেই নিশ্চয়তা করতে ইনস্টিটিউটটি সর্বশেষ খণ্ডগুলো সরবরাহ করবে বলে জানিয়েছে।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ বছর থেকে ৬৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিন রাজত্বের (থ্রি কিংডমস পিরিয়ড) সময়কালে কোরিয়ায় বৌদ্ধধর্মের প্রচলন শুরু হয়। ঐতিহাসিক দলিল অনুসারে, বৌদ্ধধর্ম সর্বপ্রথম ৩৭২ খ্রিস্টাব্দে গগোরিও থেকে ৩৮৪ খ্রিস্টাব্দে বায়েকি হয়ে ৫২৭ খ্রিস্টাব্দে সিলা রাজ্যে প্রবেশ করে। শাসক শ্রেণীর সমর্থন এই ধর্মের গ্রহণকে সহজ করেছিল। কারণ, শাসকেরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, বৌদ্ধধর্ম তাদের রাজ্যগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।

কোরিয়ায় বৌদ্ধধর্মের প্রচলন এর সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক বিকাশে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। বৌদ্ধ মন্দির, মূর্তি এবং চিত্রকর্ম কোরিয়ার ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল বুলগুক-সা মন্দির এবং Seokguram গ্রোটো, উভয়ই ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।

দুই কোরিয়া যখন এক ছিল সিলা যুগে (৬৬৮-৯৩৫) বৌদ্ধধর্ম বিকশিত হয় এবং রাষ্ট্রধর্মে পরিণত হয়। এই যুগে অনেক বিশাল মন্দির নির্মাণ করা হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ রচিত হয়। গোরিও রাজবংশ (৯১৮-১৩৯২) বৌদ্ধধর্মকে সমর্থন অব্যাহত রাখে, ফলে ত্রিপিটক কোরিয়ান ভাষায় সৃষ্টি হয়, যা কাঠের খণ্ডে খোদাই করা বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের একটি বিস্তৃত সংগ্রহ। এই কাজটি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পূর্ণ বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের সংগ্রহ হিসাবে বিবেচিত হয়।

উল্লেখ্য যে, জোসিয়ন রাজবংশের (১৩৯২-১৮৯৭) সময়কালে কনফুসিয়াসবাদকে রাষ্ট্রীয় চিন্তাধারা হিসেবে প্রচার করা হলে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কমতে থাকে। তা সত্ত্বেও, বৌদ্ধধর্ম টিকে ছিল এবং কোরিয়ান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপাদানগুলি গ্রহণ করে বিবর্তিত হতে থাকে।

ভদান্ত জিকওয়ান এর কোরিয়ান বৌদ্ধধর্মের একটি বিশ্বকোষ সম্পাদনা করার প্রচেষ্টা কোরিয়ান সমাজে বৌদ্ধধর্মের স্থায়ী গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে। ধর্মের ইতিহাস, পদ্ধতি এবং সাংস্কৃতিক অভিযোজনগুলি নথিভুক্ত করে, ‘কাসান বৌদ্ধ বিশ্বকোষ’ কোরিয়ার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে বৌদ্ধধর্মের গভীর প্রভাবের স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে কাজ করে।

এই বিশ্বকোষের সমাপ্তি কোরিয়ান বৌদ্ধ ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এটি পণ্ডিত, ধর্মানুশীল ব্যক্তি এবং সাধারণ মানুষকে কোরিয়ায় বৌদ্ধধর্মের সমৃদ্ধ ও জটিল ইতিহাস বোঝার জন্য একটি অমূল্য সম্পদ সরবরাহ করে।

শেয়ার করে সবাইকে পড়ার সুযোগ দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!