ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু || লেখক
বৌদ্ধ ধম্ম: ২০১৪ সালের ১৯ শে ডিসেম্বর ভারতে ‘PK’ নামে একটি হিন্দি চলচিত্র বা সিনেমা প্রকাশ পায়। তাতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত চলচিত্র অভিনেতা আমির খান।
PK ফিল্মে একমাত্র বৌদ্ধ ধম্মকে বাদ দিয়ে অন্যান্য সমস্ত ধর্মের প্রতারণা, ঠকবাজ ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে আক্রমণ করা হয়েছে। পাঠকগণ! আপনারা ভাবতে পারেন যে, পৃথিবীতে কোটি কোটি লোকের অনুসৃত অন্যতম একটি ধম্মকে চলচিত্রে কিভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে? আজ এখানে সে সম্পর্কে আলোকপাত করব।
বৌদ্ধ ধম্মকে চলচিত্র হতে বাদ দেওয়ার কারণ ইহাই ছিল যে, বৌদ্ধ ধম্মে ধম্মের নামে কোন ভণ্ডামি, প্রতারণা, কপটতা, ধোঁকাবাজী, আর্থিক লুঠতরাজ, দৈববাদ ইত্যাদির স্থান নাই। অর্থাৎ মিথ্যার কোন আশ্রয় নাই। যা সত্য, বাস্তব, বিজ্ঞান সম্মত ও প্রত্যক্ষ তাহাই প্রকাশ করা হয়েছে।
কিন্তু PK চলচিত্রে এমন এক অধ্যায় তৈরী করা হয়েছিল, যা দেখে অন্যান্য সমস্ত ধর্মের অনুসারীরা একত্র হয়ে প্রতিবাদ শুরু করেছিল যে, বাকী ধর্মকে বাদ দিয়ে কেবল বৌদ্ধ ধম্মকে কেন শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো হয়েছে? এ বিষয়টি নিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা শুরু হয়েছিল। দিন দিন আক্রোশ বেড়ে যাচ্ছিল। বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা বাড়ছিল। অবশেষে চলচিত্র সেন্সর বোর্ড অধ্যায়টি বাদ দিতে বাধ্য হয়েছিল। সে অংশটি বাদ না দিলে কেবল ভারতে নয়, অন্যান্য দেশেও বৌদ্ধ ধম্ম প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখত।
PK চলচিত্রের নায়ক আমির খান এক বৌদ্ধ ভিক্ষু বা ভন্তের কাছে গিয়ে বসলেন। এতটুকু পর্যন্ত চলচিত্রে দেখানো হয়েছে। এর পরের অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ দেওয়া অংশটুকু ছিল নিম্নরূপ-
‘ভিক্ষুর নিকটে গিয়ে বসার পর মনে মনে তিনি চিন্তা করছিলেন, ভিন্ন বস্ত্র পরিধানে মুণ্ডিত মস্তক এ লোকটি কে? তিনি এরকম বস্ত্র কেন পরিধান করেছেন? ইত্যাদি চিন্তা করে তিনি ভিক্ষুর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন-আপনি কি ঈশ্বর বা ভগবানকে জানেন? আপনার ঈশ্বর বা ভগবানও কি অন্যদের চেয়ে ভিন্ন?’
এর উত্তরে ভিক্ষুটি উত্তর দিলেন-‘বুদ্ধ কোন ভগবান বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেননি। তিনি নিজেও ঈশ্বর বা ভগবান নন। তিনি তাঁকে এরূপ বলেছেন যে-‘পুত্র! পৃথক পৃথক ধর্মের ভগবান বলে থাকেন যে, কেবল আমার উপর বিশ্বাস করো। আমিই মোক্ষ প্রদান করব। কিন্তু বুদ্ধ বলেছেন যে, আমি ঈশ্বর কিংবা ভগবান নই। আমি মনুষ্য মাত্র। আমি মোক্ষদাতা নই, আমি হলাম কেবল মার্গদাতা।’
PK আবার প্রশ্ন করছেন-‘আমার রিমোর্টটি হারিয়ে গেছে। তা কিভাবে পাব?’ তিনি আরও বলছেন-‘আমি মোক্ষ চাইনা। আমি কেবল রিমোর্টই চাই।’
এর উত্তরে ভিক্ষু বলছেন-‘আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা করো। খুঁজে দেখো। মানবগণ মোহের বশবর্তী হয়ে ফেঁসে রয়েছে। পয়সার জন্য সব কিছু করতে পারে। সত্য, ক্ষমা, ক্ষান্তির কখনও হার হয়না। চেষ্টা করতে থাকো। অবশ্যই পাওয়া যাবে।’
এ আশ্বাসে PK’র সমস্যার সমাধান হয়নি। তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন যে, অন্যান্য লোক আশ্বাস দিয়েছেন, ভগবানের উপর ভরসা রেখো। ভগবানই রিমোর্ট এনে দিবেন এরূপ আশ্বাস দিয়েছেন। আর এ বৌদ্ধ ভিক্ষু বলছেন যে-‘তোমাকেই রিমোর্ট খুঁজতে হবে।’ মনে হচ্ছে ভিক্ষুটি পাগল। এরকম বলে তিনি চলে গেলেন।
পাঠগণ! চলচিত্রের এ অংশটি শেষ পর্যন্ত বাদ দেওয়া হয়েছে। চলচিত্রের অন্তিমে গিয়ে যখন PK সরফরাজ চলচিত্রকে সঠিক প্রমাণিত করে মিলিয়ে দিয়েছে, তখন PK বলেছেন- একজন লোকের কথাই আমার সঠিক মনে হয়েছে, তিনি হলেন বুদ্ধের অনুসারী ভিক্ষু, যিনি বলেছেন-‘খোঁজ করো। অনুসন্ধান করলেই তুমি রিমোর্ট পাবে। ভগবান বা ঈশ্বরের ভরসায় বসে থেকোনা।’
যদি PK চলচিত্রের এ অংশটি বাদ দেওয়া না হত, তাহলে আপনারাই চিন্তা করুন, বৌদ্ধ ধম্ম প্রসারের ক্ষেত্রে তা কিরূপ প্রভাব বিস্তার করত। এরূপ মন্তব্য করেছেন চলচিত্রের লেখক অভিজিত যোশী।
অনুরূপভাবে ভারতে অঙ্গুলিমাল চলচিত্র সিনেমা হলে প্রদর্শনের পর যে হারে লোকেরা বুদ্ধের প্রতি প্রভাবিত হচ্ছিল, তা দেখে ভয়ে হিন্দুত্ববাদীরা অঙ্গুলিমাল চলচিত্র প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়েছিল। এভাবে দেখতে গেলে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা সব সময় বুদ্ধ এবং বুদ্ধের শিক্ষাকেই ভয় করে থাকে। তারা জানে যতই বুদ্ধের শিক্ষা প্রসারিত হবে, ততই তাদের কাল্পনিক ও ভণ্ডামি মূলক ঐশ্বরীয় ধর্ম সমূহ অচল হয়ে যাবে। ইহাই হল বাস্তব। এজন্য তারা সবাই কোমর বেঁধে বৌদ্ধ ধম্মকেই দাবিয়ে রাখতে চায় সবসময়।