- ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
ভগবান বুদ্ধ, সম্রাট অসোক, রাজা মিলিন্দ ও সম্রাট কনিষ্কের সময়ে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সবচেয়ে বিকশিত দেশ ছিল। আফগানিস্তানকে তখন বেক্ট্রিয়া এবং বল্ক বলা হত। তা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বিকশিত প্রদেশ। ভারত হতে যে রেশম মার্গ বা Silk Route পাকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়া, চীন ও ইউরোপ পর্যন্ত গিয়েছিল সে মার্গ দিয়েই বৌদ্ধ ব্যবসায়ীদের সাথে ধম্ম প্রচারক বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ সর্বত্র বুদ্ধের শিক্ষা বিস্তার করেছিলেন।
আফগানিস্তানের বামিয়ানের বুদ্ধের অপরূপ সৌন্দর্য মণ্ডিত উঁচু দাঁড়ানো মূর্তি সমূহ যাতায়াতকারী বৌদ্ধ ব্যবসায়ীরাই নির্মাণ করেছিলেন। তাঁরা সে মূর্তি সমূহকে পূজা-বন্দনা করে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দূর দেশে ব্যবসা করতে যেতেন। মূর্তি সমূহ তাঁদেরকে সফল মার্গ দর্শকের কাজ করত।
আফগানিস্তানের গান্ধারায় যে বৌদ্ধ শিল্প কলা সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল বিশ্ব প্রশংসিত অপরূপ সৌন্দর্য মণ্ডিত। আফগানিস্তান ও চীন হতেই ক্রিষ্টোফার কলম্বাসের এক হাজার বছর পূর্বে পঞ্চম শতাব্দীতে চীনা ভিক্ষু Hui Shan এর নেতৃত্বে একদল বৌদ্ধ ভিক্ষু আমেরিকা আবিস্কার করে সেখানে ধম্ম প্রচার করেছিলেন। পাকিস্তানের পেশোয়ারে ছিল পৃথিবীর প্রথম আবাসীয় বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় তক্ষশীলা। গ্রীকো-ইণ্ডিয়ান বৌদ্ধ রাজা প্রখর বৌদ্ধ তত্ব বিশেষজ্ঞ মিলিন্দের ( শাসনকাল ১৫৫-১৩৫ খৃষ্টপূর্ব) রাজধানী ছিল পাকিস্তানের সাগলপুর, যা বর্তমানে শিয়ালকোট নামে পরিচিত। বৌদ্ধ স্থাপত্য, কলা ও শিক্ষায় এ সমস্ত এলাকার খ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপী।
আফগানিস্তানের কাবুল যাদুঘরে এখনও রক্ষিত রয়েছে ভগবান বুদ্ধের ভিক্ষা পাত্র। যা তথাগত বুদ্ধ বৈশালী বাসী হতে উপহার স্বরূপ লাভ করেছিলেন। প্রথম খৃষ্টাব্দে সম্রাট কনিষ্কের সময় তা পাটলীপুত্র (পাটনা) হতে পেশোয়ারে নেওয়া হয়েছিল এবং পেশোয়ার হতে তা পরবর্তী সময়ে কাবুলে নেওয়া হয়েছে।
আফগানিস্তানের বাল্ক শহরেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ভগবান বুদ্ধের প্রথম দ্বি-বাচিক উপাসক ব্যবসায়ী তপস্সু এবং ভল্লিক। পরবর্তীতে তাঁরা উৎকল বা উড়িষ্যা হয়ে মায়ানমারের রেঙ্গুনের পাশে ওক্কলাপা নামক স্থানে বসবাস শুরু করেছিলেন। সেখান হতে তাঁরা বুদ্ধগয়ায় ভগবান বুদ্ধের সাক্ষাত পেয়েছিলেন। পরে ভল্লিকের নামানুসারেই বাল্ক শহরের নামকরণ হয়েছে। ভগবান বুদ্ধের প্রদত্ত কেশধাতুকে দু’ভাগ করে একটি অংশ সংরক্ষিত করতে তাঁরা রেঙ্গুনে একটি চৈত্য নির্মাণ করেছিলেন, যা এখন সোয়েডাগন প্যাগোডা নামে পরিচিত।
কেশধাতুর অপর অংশ সংরক্ষিত করতে তাঁরা তাঁদের জন্ম স্থান আফগানিস্তানের বাল্ক শহরে চৈত্য বানিয়েছিলেন। কেশধাতু সংরক্ষণের জন্য ভগবান বুদ্ধের জীবদ্দশায় এ দু’টি চৈত্য পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতেই পাকিস্তানের পেশোয়ারেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক আচার্য বসুবন্ধু ও আচার্য অসঙ্গ ভ্রাতৃদ্বয়। তাঁরা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের যোগাচার বিজ্ঞানবাদের সংস্থাপক। বৌদ্ধ দর্শনের অনেক মূল্যবান গ্রন্থের তাঁরা রচয়িতা। যা বর্তমানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য পুস্তকরূপে পড়ানো হয়।
পাকিস্তান-আফগানিস্তানেই গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম সিন্ধু সভ্যতা। যা বৌদ্ধ সভ্যতারূপে প্রত্নতত্ব গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে অতীত বুদ্ধ গণের মূর্তি ও বোধিপত্রের চিহ্ন উপলব্দ হয়েছে।
বর্তমানে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সর্বত্র সে সমস্ত বৌদ্ধ সভ্যতার ধ্বংসাবশেষই কেবল অবশিষ্ট রয়েছে। অতীত মহান বৌদ্ধদের বংশধরগণ এখন ইসলামী কট্টরতার কবলে এসে গাঁজা, আফিং, মদ্যাদি সহ বিভিন্ন নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যাবসা এবং নানা রকম সন্ত্রাসী কার্যকলাপে বিশ্বব্যাপী লিপ্ত রয়েছে। একই হাল হয়েছে পাকিস্তানেরও, যেখানে এক সময় ছিল বিশ্বজোড়া বিকশিত বৌদ্ধ সভ্যতা। কারা ছিল সে দুষ্ট লোক, যারা মহান বৌদ্ধ সভ্যতাপূর্ণ বল্ক প্রদেশের পাষাণকালীন সমৃদ্ধময় স্থানকে সন্ত্রাসময় আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে পরিণত করে দিয়েছে? সিন্ধ প্রদেশের ব্রাহ্মণ মন্ত্রী চচ কর্তৃক প্রতিক্রান্তির মাধ্যমে মৌর্য বংশী বৌদ্ধ রাজা সাহসী দ্বিতীয়কে হত্যা করে সিন্ধের পতন করা হয়েছিল। অনুরূপভাবে আফগানিস্তানে বৌদ্ধ শাহী রাজাগণকে হত্যা করে সেখানে প্রতিক্রান্তি করা হয়েছে। তখন হতে আফগানিস্তানের পতন শুরু হয়েছে। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের চোখে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান এখন সন্ত্রাসময় ব্যর্থ ঘৃণিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে পুণরায় বৌদ্ধ সভ্যতা স্থাপন ব্যতীত সে দেশ সমূহের বিকাশ অসম্ভব। সম্রাট অসোকের এ সমস্ত উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় এলাকায় পুণরায় বৌদ্ধ বিচার, পরম্পরা এবং সভ্যতার পুণর্জিবীত করা ছাড়া উন্নতির আর কোন বিকল্প নাই।
আরো পড়ুন>>
- ভিন্নভাবে বুদ্ধপূর্ণিমা পালন করলো সম্যক
- সম্যক রাউজান শাখার বুদ্ধপূর্ণিমা পালন ও বৃত্তি প্রদান সম্পন্ন
- ইলোরার কৈলাশ মন্দির প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ স্তূপ
- জাতক: ধ্রুব সত্য জাতক
- বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখ
- পৃথিবী থেকে স্বর্গের দূরত্ব কত