বাঙালি ‘হিন্দু’ সমাজের বিবর্তন

বঙ্গীয় জনসাধারণ কীভাবে পাঁচ-ছয়- সাত শতাব্দীর মধ্যে ‘হিন্দু’ (সনাতনধর্মী) ও মুসলমানে বিভক্ত হয় তার একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনার চেষ্টা করা হবে এই নিবন্ধে। বলা বাহুল্য, জাতি বা কাস্টের ভিত্তিতে হিন্দু সমাজের বিভাজন। জটিল এই প্রক্রিয়াটির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিচে দেয়া হল।

এ কথা জানা যে, যাদেরকে আজ ‘হিন্দু’ বলা হয় তাদের নানা পরিচয় আছে। এদের ধর্মকে সনাতন ধর্ম বলা হয়। কেউ কেউ এক ‘চতুর্বর্ণভিত্তিক ধর্ম’ বলে। আবার ধর্মটি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বলেও পরিচিত। ব্রাহ্মণ্যধর্মে চারের পাঁচটি বজ্র আঁটুনি আছে। এই আঁটুনিগুলো হচ্ছে:

(ক) চার যুগ যথা: সত্য (১৭,২৮,০০০ বছর), ত্রেতা (১২,৯৬,০০০ বছর), দ্বাপর (৮,৬৪,০০০ বছর) ও কলি (৪,৩২,০০০ বছর),

(খ) চার বেদ যথা: ঋক, যজু, সাম ও অথর্ব,

(গ) চার আশ্রম যথা: ব্রহ্মচর্য্য (শিক্ষা জীবন), গার্হস্থ্য (সংসার জীবন), বাণপ্রস্থ (সংসারে থেকেও বৈরাগ্য) ও সন্ন্যাস (গৃহত্যাগ),

(ঘ) চার বর্গ যথা: ধর্ম, অর্থ, কর্ম, ও মোক্ষ এবং

(ঙ) চার বর্ণ যথা: ব্রাহ্মণ, ক্ষয়িত্র, বৈশ্য ও শূদ্র।

এই পাঁচটি আঁটুনি অনেক ক্ষেত্রেই আজকের দিনে শিথিল। কিন্তু চার বর্ণের ব্রাহ্মণ্য প্রথাটি হিন্দুর বিশ্বাসে এখনও দৃঢ়মূল। এই দৃঢ়মূল ভিত্তির বদৌলতে হিন্দু এখন প্রধান প্রধান ৪,৬৩৫ টি (ইণ্ডিয়া টুডে: ২০/১২/১৯৯৯) জাত-উপজাতে বিভক্ত।

উল্লেখ্য এই ৪,৬৩৫ টি জাত-উপজাত ওপর থেকে নিচ (পীরামিড)— এই ক্রমে থরে থরে সাজানো। একটি আর একটি থেকে পারস্পরিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা। একের সাথে অন্যের বৈবাহিক অথবা সামাজিক কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের রয়েছে যার যার সমাজ, রীতি-নীতি ও সংস্কার অথবা কুসংস্কার। সামাজিক গতিশীলতার (সোশ্যাল মবিলিটি) পথ এখানে রুদ্ধ। কারণ অর্থ, বিদ্যা এবং ক্ষমতা এর কোনোটাই সাধারণভাবে এক ‘জাতির’ লোককে ওপরের ‘জাতিতে’ উন্নীত করতে পারে না। ব্যবস্থাটি বর্তমানে জন্মগত ও বংশগত হওয়ায় একজনের জন্ম যে জাতে, তার মৃত্যুও হয় সেই ‘জাতে’।

এই আঁটুনি থেকে মুক্তির যেন কোনো ব্যবস্থা নেই! এই যে কারাগার এর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের পরিবারও একসময় রেহাই পায়নি। রবীন্দ্রনাথের পরিবার ‘পিরালি ব্রাহ্মণ’ বলে পরিচিত। অন্য ব্রাহ্মণরা তাঁদের হেয় চোখে দেখত। তাই ঠাকুর পরিবারের সাথে অন্য ব্রাহ্মণরা বৈবাহিক কোনো সম্পর্ক করত না।

রবীন্দ্রনাথের পরিবার যেমন সে যুগে এই আঁটুনি থেকে রেহাই পায়নি, তেমনি অধিংকাশ হিন্দু আজও রেহাই পায় না এই আঁটুনি থেকে।

বংশগত জাতের ব্যবস্থা কবে থেকে? হিন্দুদের কেউ কেউ মনে করে জাত-পাতের ব্যবস্থাটি পৃথিবীর মতই প্রাচীন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। আমরা জানি খ্রিস্টপূর্ব কাল অর্থাৎ বেদ-রামায়ণ-মহাভারতের কালে ‘জাতব্যবস্থা’ জন্মগত বা বংশগত ছিল না। বৃত্তি বা পেশার ওপর ভিত্তি করে তখন ‘জাতি’ নির্ধারিত হতো। ব্রাহ্মণ, ক্ষয়িত্র বৈশ্য ও শূদ্র ইত্যাদি ছিল বৃত্তিগত বা গুণগত বিভাজন, জন্মগত নয়। গীতায় গুণ ও কর্মের ভিত্তিতেই ‘জাত ধর্ম’ নির্ধারণের কথা আছে। তা নাহলে ভূমিপুত্র ও আর্যদের মিলন সম্ভব হতো না। আর্য রক্তের তথাকথিত বিশুদ্ধতা যদি রক্ষিত হতো, তাহলে বেদ প্রণেতা বেদব্যাসের (ব্যাসদেব) জন্ম হতো না। আমরা জানি বেদব্যাসের রক্তে মিশে আছে ভূমিপুত্রীর রক্ত।

আর্য-ভূমিপুত্রদের মিলনের অসংখ্যা উদাহরণ আছে রামায়ণ ও মহাভারতে। বস্তুত এই অবাধ বৈবাহিক সম্পর্কের ফলেই জন্মলাভ করেছেন এই দুই মহাকাব্যের প্রধান প্রধান চরিত্র। এমনকি মহাভারতীয় সমাজে জারজ সন্তানরাও স্বীকৃত হতো। তার অর্থ হচ্ছে প্রাচীনকালে ‘রক্তের বিশুদ্ধতার’ ভিত্তিতে বংশভিত্তিক জাতি সৃষ্টির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। গুণের ভিত্তিতে রচিত জাতি বিন্যাসে যে কেউ ওপরের জাতিতে উন্নীত হতে পারত। বিশ্বামিত্র তার বড় একটি উদাহরণ। তিনি ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণে উন্নীত হয়েছিলেন।

তাহলে কি বেদ-রামায়ণ-মহাভারতের কালের পরেই রক্তের বিশুদ্ধতাভিত্তিক জাতের উৎপত্তি? না, তাও নয়। আমরা জানি রামায়ণ ও মহাভারতের পরবর্তীকাল হচ্ছে জৈন-বৌদ্ধ কাল। ভারতে এই কালের ব্যাপ্তি ছিল কমপক্ষে হাজার বছর (খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দ)।

এ কথা জানা জৈন ও বৌদ্ধধর্মে জাত-পাত ছিল না। সকল মানুষ ছিল সমান। সকলেই ঈশ্বরের সন্তান। বৌদ্ধরা বেদ মানতেন না। বস্তুত জাত-পাতের বিরোধিতা, ব্রাহ্মণের আধিপত্য বিনাশ ও যজ্ঞকর্মের বিরোধিতা করেই বৌদ্ধধর্মের বিকাশ।

একসময়ে সারা ভারত হয়ে যায় বৌদ্ধ। তাই বলা যায় বৌদ্ধ আমলে রক্তের বিশুদ্ধতা তো দূরের কথা বরং রক্তের মিশ্রণের ফলে ভারতীয় সকল জাতিই সন্দেহাতীতভাবে সংকরত্ব প্রাপ্ত হয়। আর্যদের রক্তের বিশুদ্ধতা দাবির যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা তছনছ হয়ে যায়।

তাহলে প্রশ্ন: কবে থেকে এবং কি ভিত্তিতে এই বংশভিত্তিক জাতপাতের সৃষ্টি

বাঙালি হিন্দুর সামাজিক ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায় যে, এই জন্মগত জাতি ভেদ প্রথাটির বয়স বড় জোর সাত-আট শত বছর। কিভাবে এই প্রথাটির উদ্ভব হয়েছে তার একটা সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন ড. অতুল সুর (বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন: সাহিত্য লোক: ১৯৯৪) ড. সুর তাঁর এই গ্রন্থে বাংলার সামাজিক বিবর্তনের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তাতে দেখা যায় প্রাক্-পাল যুগে (প্রাক্ ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় চার বর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষয়িত্র, বৈশ্য ও শূদ্র) কোনো সমাজ ছিল না। অষ্টম শতাব্দির পূর্বে বাংলায় ছিল কৌম (ট্রাইব) ভিত্তিক সমাজ। বাংলার জনপদগুলোও এই কৌম জাতির নামেই অভিহিত হতো। এই কৌম জাতিগুলো ছিল: পুণ্ড্র (পোদ), বঙ্গ, কর্বট (কৈবর্ত্য), বাগদি, সদ্‌গোপ ও মল ইত্যাদি।

প্রাক্-পাল আমলে ধীরে ধীরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ব্রাহ্মণরা বাংলায় আসা শুরু করে। তাদের উপাধি ছিল শর্মা, ও স্বামিন ইত্যাদি। তাদের মধ্যে কালক্রমে গাঁই প্রথা চালু হয়। যে গ্রামে তারা প্রথম উঠত সেই গ্রামের নামেই গাঁই প্রথা (ভট্ট, চট্ট, বন্দ্যো ইত্যাদি)।

এই সময়ে অব্রাহ্মণ জাতিসমূহের নামের শেষাংশে থাকত: দত্ত, পাল, মিত্র, বর্মণ, দাস, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ, কুণ্ড, পালিত, নাগ, চন্দ্র, দাম, ভূতি, বিষ্ণু, যশ, শিব ও রুদ্র ইত্যাদি।

বলা বাহুল্য এগুলো এখন ‘কায়স্থ’ জাতির পদবি হলেও তখন ছিল নিতান্তই নামের শেষাংশ (জাতিবাচক নয়)। কারণ তখন ‘কায়স্থ’ বলে কোনো জাতি ছিল না। এই যুগেই রাজকর্মচারি হিসেবে কিছু লোকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তাদের উপাধি হচ্ছে: প্রথম কায়স্থ, জ্যেষ্ঠ কায়স্থ ও করণ। ‘কায়স্থ’ শব্দ ব্যবহৃত হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা ছিল রাজ কর্মচারী, জাতি নয়।

অপর দিকে কিছু লোকের উপাধি হিসেবে পাওয়া যায়: নগরশ্রেষ্ঠী, স্বার্থবাহ ও ব্যাপারী ইত্যাদি। উপাধি থেকে তাদের ব্যবসায়ী হিসেবে মনে হলেও এরা ‘বৈশ্য’ জাতির লোক ছিল না। কেউ বৈশ্যত্ব দাবি করেছে বলেও কোনো প্রমাণ নেই। এর থেকে বোঝা যায় প্রাক-পাল যুগে স্থানীয়দের মধ্যে জন্মগত কোনো জাতিভেদ ছিল না। অর্থাৎ সমাজটি ছিল জাত-পাতহীন একটি সমতল সমাজ।

পরবর্তীকালে অর্থাৎ পাল আমলেও (খ্রিস্টাব্দ ৭৫০-১২০০) সামাজিক চিত্র প্রায় অভিন্ন ছিল। এ যুগে কর্ম বা বৃত্তিভিত্তিক আরও কিছু উপাধির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে: প্রতিবেশী, ক্ষেত্রকার (ভূমিকর্ষক), কুটুম্ব (প্রধান প্রধান গৃহস্থ), মেদ, অন্ধ্র, চণ্ডাল।

এ দিকে চর্যাপদে (দশম শতাব্দী) উল্লেখ পাওয়া যায় আরও কয়েকটি জাতির। এরা হচ্ছে ডোম, শবর, কাপালিক ইত্যাদি। তাদের ছিল ভিন্ন ভিন্ন পেশা। এগুলো কোনো জাতির পরিচয় নয়।

আমরা জানি পালেরা ছিলেন বৌদ্ধ। তারা জাত পাত মানতেন না। ফলে অবাধ বিবাহের মাধ্যমে জাতিই সংকরত্ব প্রাপ্ত হয়। উল্লেখিত সমতল সমাজে বসবাসকারী বহিরাগত ব্রাহ্মণরা রাজাদের কাছ থেকে দান হিসেবে ভূমিলাভ করে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়। পাল রাজারাও ব্রাহ্মণদের অসম্মান করতেন না। এ সুযোগে নবম-দশম শতাব্দীর দিকেই ব্রাহ্মণরা জাতিভেদ প্রথার বীজ রোপণ করতে থাকে। তারা সুযোগ বুঝে চার বর্ণের আদলে সমাজকে বিভক্ত করার উদ্যোগ নেয়।

বলা হয় ব্রাহ্মণ বাদে বাংলার সকল মানুষই ‘সংকর’ এবং শূদ্র। কেবল মাত্র ব্রাহ্মণই নির্ভেজাল। তবে সরকারী কর্মচারিরা নিজেদেরকে ‘কায়স্থ’ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে। দেখাদেখি ‘কৈবর্ত্য’ ইত্যাদি জাতিরাও নিজেদেরকে স্বতন্ত্র ভাবতে শুরু করে। কিন্তু এই দাবিগুলো কোনো আনুষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি।

পালযুগের শেষে আসে সেন রাজত্ব (ত্রয়োদশ শতকে)। বলাল সেনের সমসাময়িক কালে রচিত ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণেই’ প্রথম পাওয়া যাচ্ছে বাঙালি হিন্দুর জাতিবিন্যাস। এই ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ দিয়ে আরম্ভ করে পরবর্তীকালে সামাজিক বিবর্তনের সাথে সাথে হিন্দুর জাতিবিন্যাসও বারবার পরিবর্তন হয়। এই ক্রম বিকাশটি নিচে আলোচনা করা হল:

১. বৃহদ্ধর্মপুরাণের শ্রেণি বিভাগ: ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণে’ (দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী) বাঙালি হিন্দুদেরকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এই তিনটি শ্রেণি হচ্ছে (ক) উত্তম সঙ্কর (খ) মধ্যম সঙ্কর ও (গ) অন্ত্যজ।

উপরোক্ত তিন শ্রেণিতে কারা পড়েছিল তা নিচে প্রদত্ত হল:

  • উত্তম সঙ্কর: শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণ যাদের পুরোহিত হিসেবে কাজ করত তারাই উত্তম সংকর।

এদের মধ্যে আছে: ১. করণ ২. অম্বষ্ঠ ৩. উগ্র ৪. মগধ ৫. গন্ধবণিক ৬. কাংস্যবণিক ৭. শঙ্খবণিক ৮. কুম্ভকার ৯. তন্তুবায় ১০. কর্মকার ১১. সদগোপ ১২. দাস ১৩. রাজপুত ১৪. নাপিত ১৫. মোদক ১৬. বারুজীবী ১৭. সুত ১৮. মালাকার ১৯. তাম্বুলি ও ২০. তৈলক।

  • মধ্যম সঙ্কর: ১. তক্ষক ২. রজক ৩. স্বর্ণকার ৪. সুবর্ণবণিক ৫. আভীর ৬. তৈলক ধীবর ৮. শৌণ্ডিক ৯. নট ১০. শবক ১১. জালিক
  • অন্ত্যজ: ১. গৃহি ২. কুড়ব ৩. চণ্ডাল ৪. বাদুর ৫. চর্মকার ৬. ঘট্টজীবী ৭. দোলবাহী ও ৮. মল।

ওপরের শ্রেণী বিভাজনটির দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, এটি ‘সংকরত্বের’ ভিত্তিতে রচিত। যেহেতু ব্রাহ্মণ সংকর নয়, তাই তাদের উল্লেখ এতে নেই। ব্রাহ্মণ বাদে উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর ও অন্ত্যজ এই তিনটি শ্রেণিতে মোট ৩৯ টি জাতি স্থান পেয়েছে।

এই তিন শ্রেণীভুক্ত ৩৯ টি জাতির বাইরে স্থানপ্রাপ্ত আরও কয়েকটি ম্লেচ্ছ জাতির উল্লেখ আছে। এগুলো হচ্ছে: পুলিন্দ, কক্কস, যবন, খস, সৌম্য, কম্বোজ, শবর ও খর।

কিন্তু লক্ষনীয় এই তালিকায় কয়েকটি প্রভাবশালী জাতির নাম নেই। এই জাতিগুলো হচ্ছে: বাগদি, ডোম, ও কৈবর্ত। এই শ্রেণি বিভাজনে আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। দেখা যাচ্ছে কাংস্য বণিক, শঙ্খবণিক ও গন্ধবণিকরা স্থান পেয়েছে উত্তম সংকর হিসেবে। কিন্তু প্রভাবশালী সুবর্ণ-বণিকরা স্থান পেয়েছে মধ্যম সংকরে। আবার প্রভাবশালী ‘মল্লদের’ স্থান অন্ত্যজ শ্রেণিতে।

বিপরীতে নাপিতের স্থান উত্তম সংকরে। এসব দেখে ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণের’ শ্রেণী বিভাজনের প্রকৃত ভিত্তি কী সে সম্বন্ধে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক৷

২. অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ: ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ রচনার কিছুকালের মধ্যেই জাতিবিন্যাসটিকে আরও পাকাপোক্ত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয়। কারণ ইতোমধ্যেই মুসলমান শাসনের ফলে সমাজে হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠে।

ড. সুরের মতে তাই স্মার্ত পণ্ডিতগণ (বেদে বিশ্বাসী) একটি ‘মীথ’ (অতিকথন) তৈরি করে। বলা হয় বাংলার হিন্দুদের মধ্যে পিতৃকুলে নতুবা মাতৃকুলে উচ্চবর্ণের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আর এটি হচ্ছে দুই রকমের বিবাহ প্রথার মাধ্যমে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘অনুলোম’ বিবাহ এবং অন্যটি হচ্ছে ‘প্রতিলোম’ বিবাহ।

উচ্চবর্ণের পুরুষ নিচ বর্ণে বিবাহ করলে এটিকে বলা হতো ‘অনুলোম বিবাহ’। বিপরীতটি হচ্ছে ‘প্রতিলোম বিবাহ’। এই ধরনের বিবাহ বন্ধন থেকে জন্মলাভকারী সন্তানদের জাতি কী হবে? পিতা ও মাতার জাতিকে ভিত্তি হিসেবে ধরে এ প্রশ্নের সমাধান করা হয়।

বৌধায়ন ধর্মসূত্র, বৃহদ্ধর্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, মনুসংহিতা, মহাভারত, পরাশর, সূত সংহিতা উশানস সংহিতা, বিষ্ণু ধর্মসূত্র, বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র, যাজ্ঞবল্ক্য ও জাতিমালা ইত্যাদি মোট ১৩ টি সূত্র অবলম্বন করে ড. সুর এ ধরনের মোট ৩১টি মিশ্র জাতির উল্লেখ করেছেন।

নিচে এর তালিকা দেয়া হল:

একত্রিশ জাতির তালিকা

ক্র:নং জাতি পিতা মাতা
অম্বষ্ঠ ব্রহ্মণ বৈশ্য
    ক্ষত্রিয় বৈশ্য
আগুরি করণ রাজপুত্র
উগ্র ক্ষত্রিয় শূদ্র
    ব্রহ্মণ শূদ্র
    বৈশ্য শূদ্র
কর্মকার বিশ্বকর্মা ঘৃতাচি
    শূদ্র বৈশ্য
    শূদ্র ক্ষত্রিয়
করণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য
চর্মকার শূদ্র ক্ষত্রিয়
    বৈদেহক ব্রাহ্মণ
    বৈদেহক নিষাদ
    আয়োগব ব্রাহ্মণ
    তিবর চণ্ডাল
    তক্ষণ বৈশ্য
তিলি গোপ বৈশ্য
তেলি বৈশ্য ব্রাহ্মণ
তামলি বৈশ্য ব্রাহ্মণ
১০ কংসবণিক ব্রহ্মণ বৈশ্য
১১ চণ্ডাল শূদ্র ব্রাহ্মণ
১২ নাপিত ব্রাহ্মণ শূদ্র
    ক্ষত্রিয় শূদ্র
    ব্রাহ্মণ বৈশ্য
    ক্ষত্রিয় নিষাদ
১৩ বাগ্দী ক্ষত্রিয় বৈশ্য
১৪ হাড়ি লেট চণ্ডাল
১৫ সবর্ণবণিক অম্বষ্ঠ বৈশ্য
    বিশ্বকর্মা ঘৃতাচি
১৬ গন্ধবণিক ব্রাহ্মণ বৈশ্য
    অম্বষ্ঠ রাজপুত্র
১৭ কায়স্থ ব্রাহ্মণ বৈশ্য
১৮ কৈবত নিষাদ আয়োগব
    শূদ্র ক্ষত্রিয়
    ব্রাহ্মণ শূদ্র
    নিষাদ মগধ
১৯ গোপ বৈশ্য ক্ষত্রিয়
    ক্ষত্রিয় শূদ্র
২০ ডোম লেট চণ্ডাল
২১ তন্তুবায় শূদ্র ক্ষত্রিয়
    বিশ্বকর্মা ঘৃতাচি
২২ ধীবর গোপ শূদ্র
    বৈশ্য ক্ষত্রিয়
২৩ নিষাদ ব্রাহ্মণ শূদ্র
    ব্রাহ্মণ বৈশ্য
    ব্রাহ্মণ শূদ্র
২৪ পোদ বৈশ্য শূদ্র
২৫ মালাকার বিশ্বকর্মা ঘৃতাচি
    ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ
২৬ মাহিষ্য ক্ষত্রিয় বৈশ্য
২৭ মোদক ক্ষত্রিয় শূদ্র
২৮ রজক বৈদেহক ব্রাহ্মণ
    ধীবর তিবর
    করণ বৈশ্য
২৯ বারুজীবী ব্রাহ্মণ শূদ্র
    গোপ তন্তুবায়
৩০ বৈদ্য ব্রাহ্মণ বৈশ্য
    শূদ্র বৈশ্য
৩১ শুড়ি বৈশ্য তিবর
    গোপ শূদ্র

 

ওপরের তালিকাটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণে’ জাতিবিন্যাসের জন্য গৃহীত ‘সংকরত্বের’ তত্ত্বকে অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ তত্ত্বের মাধ্যমে পাকাপোক্ত করা হয়।

এই তালিকার সব জাতিই (৩১টি) সংকর বা মিশ্রজাতি। উদাহরণ হিসেবে শুধু কোন জাতির রক্তে কোন বর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষয়িত্র, বৈশ্য, ও শূদ্র) রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তাই দেখানো হয়েছে মাত্র। ওপরে প্রদত্ত ৩১ টি জাতির তথ্যে দেখা যাচ্ছে ব্রাহ্মণ পিতা ও বৈশ্য মাতার (অনুলোম বিবাহ) সন্তানদেরকে মোট সাতটি ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। এই সাতটি জাতি: অম্বষ্ঠ, কংসবণিক , নাপিত, গন্ধবণিক, কায়স্থ, নিষাদ ও বৈদ্য।

অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে ক্ষয়িত্র পিতা ও বৈশ্য মাতার (অনুলোম বিবাহ) সন্তানদেরকে মোট চারটি জাতিতে বিভক্ত করা হয়েছে। এরা হচ্ছে: অম্বষ্ঠ, করণ, বাগদী ও মাহিষ্য।

এই কয়েকটি উদাহরণ থেকে বোঝা যায় একই বর্ণের পিতা-মাতার সন্তানদেরকে গোষ্ঠীভুক্ত করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে। অথচ হিসাবে সমীকরণটি দাঁড়ায় এইরূপ: অম্বষ্ঠ= কংসবণিক= নাপিত= গন্ধবণিক= কায়স্থ= নিষাদ= বৈদ্য এবং অম্বষ্ঠ= করণ= বাগদী= মাহিষ্য। অর্থাৎ রক্তের মিশ্রণের ভিত্তিতে সব সমান। কিন্তু তথাকথিত পণ্ডিতরা তা করেননি। একেই বোধ হয় বলা যায় এক যাত্রার দুই ফল! তা না হলে একই জাতির পিতা-মাতার সন্তান ভিন্ন ভিন্ন জাতিভুক্ত কেন হবে?

স্পষ্টতই বোঝা যায় এটি একটি মনগড়া ব্যবস্থা। এই অযৌক্তিক ব্যবস্থাই পরবর্তীকালে ‘কুল’ প্রথা হিসেবে চালু হয়। পরিণামে ‘কওম’ ব্যবস্থা হয় তিরোহিত।

৩. ধর্মপুরাণের শ্রেণী বিভাগ: ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণে’ প্রদত্ত ‘সংকরত্ব’ ভিত্তিক ৩৯ টি জাতি তৈরির প্রায় তিন-চার’শ বছর পরে (ষোড়শ শতাব্দী) ভিন্ন একটি জাতি তালিকা পাওয়া যায় ময়ূর ভট্টের ‘ধর্মপুরাণে’।

মনে হয় এটি একটি ‘আন্তঃগোষ্ঠী’ বিবাহ (এণ্ডোগেমাস) ভিত্তিক তালিকা। এই তালিকায় উল্লেখিত ৩৮টি জাতি হচ্ছে: ১. সদগোপ ২. কৈবর্ত ৩. গোয়ালা ৪. তাম্বুলি ৫. উগ্রক্ষেত্রী ৬. কুম্ভকার ৭. তিলি (একাদশ শ্রেণী) ৮. যোগী ৯. আশ্বিন ১০. তাঁতি ১১. মালী ১২.মালাকার ১৩. নাপিত ১৪ রজক ১৫. দুলে ১৬. শঙ্খধর ১৭. হাড়ি ১৮. মুচি ১৯. ডোম ২০. কলু ২১. চণ্ডাল ২২. মাজি ২৩. বাগদী ২৪. মেটে ২৫. স্বর্ণকার ২৬. সুবর্ণবণিক ২৭. কর্মকার ২৮. সূত্রধর ২৯. গন্ধ বেণে ৩. ধীবর ৩১. পোদ্দার ৩২. ক্ষয়িত্র ৩৩. বারুই ৩৪. বৈদ্য ৩৫. পোদ ৩৬. পাকমারা ৩৭. কায়স্থ ও ৩৮. কেওরা।

ওপরের তালিকাটির (৩৮ টি) সাথে ‘ বৃহদ্ধর্মপুরাণের ’তালিকাটির (৩৯ টি) তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যায় ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণে’ উল্লেখিত ২০/২২ টি জাতি ওপরের তালিকায় অনুপস্থিত। আবার নতুনভাবে ২০/২২ টি জাতি এতে যোগ হয়েছে। এতে মনে হয় পুরনো জাতির মৃত্যু হচ্ছে, নতুন নতুন জাতি তৈরি হচ্ছে। কি ভিত্তিতে তা হচ্ছে এটি স্পষ্ট নয়।

৪. নবশাখ: ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ ও ‘ধর্মপুরাণের’ শ্রেণী বিভাজনের পরে আরও একটি শ্রেণি বিভাজন করা হয়। এর দ্বারা সৃষ্ট হয় ‘নবশাখ’। ‘নবশাখ’ করার ভিত্তি কী? যাদের হাত থেকে ব্রাহ্মণরা জল গ্রহণ করত তারাই ‘নবশাখ’ (জল-চল)। এই নবশাখরা হচ্ছে: ১. তিলি, ২. তাঁতী, ৩. মালাকার, ৪. সদগোপ, ৫. নাপিত, ৬. বারুই, ৭. কামার, ৮. কুম্ভকার ও ৯. মোদক। বলা বাহুল্য অন্য জাতিসমূহ ছিল জল অচল। অর্থাৎ ‘নবশাখ’ তৈরির মাধ্যমে দুটো শ্রেণি সৃষ্টি করা হয়। একটি জল-চল এবং অন্যটি জল-অচল।

৫. ব্রাহ্মণদের শ্রেণি বিভাগ: লক্ষণীয় এই শ্রেণি বিভাজনের খাতা থেকে ব্রাহ্মণরাও শেষ পর্যন্ত রেহাই পায়নি। অন্যান্য জাতির পাশাপাশি তারাও তিন ভাগে বিভক্ত হয়। এই তিনটি ভাগ হচ্ছে: ১. মুখ্য কুলীন (বন্দ্যো, চট্ট্যো, মুখটি, ঘোষাল, পতিতুণ্ড, গাঙ্গুলী, কাঞ্জীলাল ও কুন্দলাল) ২. গৌণ কুলীন (রায়ী, গুড়, মাহিন্ত, কুলভী, চৌতখণ্ডি, পিপুলাই, গড়াগড়ি, ঘন্টাসরী, কেশরকোনা, দিমসাই, পরিহল, হাড়, পিতামুণ্ডী, ও দীর্ঘাতি) ও ৩. শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণ।

৬. গোত্রের মর্মার্থ: জাতি বিন্যাস অথবা জন্মগত (কুলগত) জাতি ব্যবস্থার আর একটি দিক আলোচনা করা দরকার। এই দিকটি হচ্ছে ‘গোত্র’ (ট্রাইব?)।

বাঙালি হিন্দুর ‘জাতি’ (কাস্ট) নির্ণয়ে গোত্রকেও একটি নির্দেশিকা হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা রয়েছে। গোত্র থেকে কেউ কেউ তাদের কৌলীন্য স্থির করার প্রচেষ্টা চালায়। অথচ দেখা যায় এই গোত্রগুলোর ভিত্তিও হাস্যকর। দেবীপ্রসাদ চট্রোপাধ্যায়ের মতে (লোকায়ত দর্শন: নিউ এজ পাবলিশার্স প্রা: লি: কলকাতা দ্বিতীয় খণ্ড: ১৯৯৫) গোত্র নামগুলো নানা টোটেম বিশ্বাস থেকে উদ্ভুত। তিনি ব্রাহ্মণাদি উচ্চ-বর্ণের অন্তর্গত কয়েকটি বিখ্যাত গোত্রের নামগুলো কোত্থেকে এসেছে তার একটি তালিকা দিয়েছেন ।

তালিকাটি নিম্নরূপ:

গোত্র কোত্থেকে গোত্র কোত্থেকে
ভরদ্ধাজ ভরত পাখি কৌশিক পেঁচা
গৌতম গরু শান্ডিল্য পাখি
কাশ্যপ কাছিম বাৎস বাদুর
গুণক কুকুর মাণ্ডুকেয় ব্যাঙ
দার্ভায়ন দুর্বা ঘাস মৌদগল্য মাগুর মাছ
    তৈত্তিরীয় তিতির পাখি

স্পষ্টতই দেখা যায় গোত্রের নাম আসলে ‘টোটেম’ বিশ্বাসের ফল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই গোত্র নামগুলোকে ভদ্রস্থ করার জন্য মুনি-ঋষিদের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। বস্তুত এই ধরনের গোত্রনাম আজও ‘ট্রাইবাল’ সমাজে বিদ্যমান। ‘মাহিলী’ নামীয় এক ট্রাইবের গোত্র নাম ‘হস্তোয়ার’। সংস্কৃতে তার অর্থ ‘কাশ্যপ’। লক্ষণীয়, গোত্রগুলি যেমন ‘টোটেম’ থেকে উদ্ভূত, তেমনি বিভিন্ন জাতি আবার একই গোত্রনাম ব্যবহার করে। তা হলে প্রশ্ন করা যায়: গোত্র এক হলে জাতি ভিন্ন ভিন্ন হয় কী করে?

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় জাতিভেদ প্রথার মূল ভিত্তি বিভিন্ন পুরাণ যথা: ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’ ও ধর্মপুরাণ ইত্যাদি। এর সাথে যোগ হয়েছে নানা কুলজী গ্রন্থ। এই সব পুরাণ ও কুলজী গ্রন্থে সন্নিবেশিত জাতি তালিকা বিশ্লেষণ করলে প্রথমত কয়েকটি অসঙ্গতি ধরা পড়ে এবং দ্বিতীয়ত এগুলোর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

প্রথমেই অসঙ্গতির বিষয়টি আলোচনা করা যাক। দেখা যায় ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণের’ তালিকাতে মোট জাতির সংখ্যা ৩৯ টি। অপর দিকে ‘ধর্মপুরাণে’ উল্লেখিত জাতির সংখ্যা ৩৮টি। এই দুই তালিকার মধ্যে আবার জাতির নামে যথেষ্ট গড়মিল রয়েছে। দ্বিতীয়ত ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণে’ হিন্দুদেরকে তিন শ্রেণিতে (উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর, ও অন্ত্যজ) ভাগ করা হয়েছে।

স্পষ্টতই এই ভাগের ভিত্তি হচ্ছে ‘সংকরত্ব’। ব্রাহ্মণরা যেহেতু ‘পিউর’ (?) তাই তারা এই তালিকায় নেই। অপরদিকে ‘ধর্মপুরাণে’র শ্রেণী বিভাজনে সংকরত্বের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। এটি আন্তঃগোষ্ঠী বিবাহের ভিত্তিতে তৈরি। এখানে উল্লেখ শুধু জাতির। তৃতীয়ত ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণে’র তালিকায় যে জাতিগুলোর উল্লেখ আছে, ‘ধর্মপুরাণের’ তালিকায় তার সবগুলো নেই। এতে সংযোজন ও বিয়োজন আছে। তবে দুটো জিনিস লক্ষণীয়। দুই তালিকার একটিতেও ব্রাহ্মণের স্থান নেই। আবার প্রথমটিতে কায়স্থ নেই। কিন্তু দ্বিতীয়টিতে আছে। জল-চল ও জল-অচল এই ধরনের বিভাজন তো রীতিমত বর্ণবাদী ও প্রক্রিয়াশীল একটি বিভাজন।

এখন প্রশ্ন: পুরাণ কাহিনী ও কুলজী গ্রন্থগুলো কতটুকু নির্ভরযোগ্য? রজনীকান্ত চক্রবর্তীর মতে (গৌড়ের ইতিহাস: দে’জ পাবলিশিং: ১৯৯৯) ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ ও ’ব্রহ্ম বৈবর্তপুরাণ’ সম্পূর্ণ অমূলক ও কল্পনাপ্রসূত। ইদানীং কালের গবেষকরাও এই সমস্ত পুরাণ ও কুলজী গ্রন্থগুলোকে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করেন না। ব্যাসদেবের নামে এগুলোকে এবং কখন সংকলিত করেছে তা জানা যায় না।

সাধারণ বুদ্ধিতে বিচার করলেও বোঝা যায় যে, পুরাণ ও কুলজী গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত কাহিনী ও এগুলোর ভিত্তি নিতান্তই মন গড়া, উদ্ভট ও বিদ্বেষপ্রসূত। আপাতদৃষ্টিতে জাতিবিন্যাসের ভিত্তিগুলো হচ্ছে: (ক) বৃত্তিগত (খ) কর্মগত ও (গ) নৃতাত্ত্বিক। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তথাকথিত শাস্ত্রকাররা জাতি বিন্যাস করতে গিয়ে কখনও আশ্রয় নিয়েছেন ‘সংকরত্বের’ ওপর, কখনও অনুলোম-প্রতিলোম বিবাহের ওপর, কখনও ব্রাহ্মণ কর্তৃক জলের গ্রহণযোগ্যতার ওপর, কখনও খেয়াল-খুশির ওপর এবং কখনও কল্পকাহিনীর ওপর।

কল্পকাহিনীর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’ (ব্যাস বিরচিত: সম্পাদনা: সুবোধচন্দ্র মজুমদার: দেবসাহিত্য কুটীর (প্রা:) লি: ২০০০) নয়টি জাতির জন্ম কথা উল্লেখিত হয়েছে। এই নয়টি জাতি হচ্ছে: মালাকার, কাংস্যকার, তন্তুবায়, স্বর্ণকার, কর্মকার, শঙ্খকার, সূত্রধর, কুম্ভকার, এবং চিত্রকর।

বলা হয়েছে এদের জন্ম বিশ্বকর্মার ঔরসে ও ঘৃতাচীর গর্ভে। এই বিশ্বকর্মা ঘৃতাচীর অভিশাপে ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করে। আবার স্বর্গবেশ্যা ঘৃতাচী বিশ্বকর্মার উল্টো অভিশাপে শূদ্রাণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। এই বিশ্বকর্মা ও ঘৃতাচীর নয়টি পুত্র সন্তান হয়। এরাই পূর্বোক্ত নয়টি ‘জাতি’।

এ কাহিনী শুধু হাস্যকর কল্পকথা নয়, রীতিমত বিদ্বেষপ্রসূত, মানহানিকর ও কুরুচিপূর্ণ। অথচ এই হাস্যকর, বিদ্বেষভিত্তিক ও অযৌক্তিক‘ জাতি’ ব্যবস্থাই বিনা প্রতিবাদে শেষ পর্যন্ত বৃত্তি, কর্ম অথবা নৃতত্ত্ব নির্বিশেষে জন্মগত বা বংশগত (কুলগত) ব্যবস্থা হিসেবে বিকাশ লাভ করে। ফলে দেখা যায় ধর্ম যেখানে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা, সেখানে হিন্দুর ধর্ম তাকে করেছে বহুধা বিভক্ত।

বর্তমানে বাঙালি হিন্দু সামাজিকভাবে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, নবশাখ ও অন্যান্য জাতিতে বিভক্ত। সামাজিক বাস্তবতাকে রাষ্ট্রও আবার স্বীকার করে নিয়েছে। বাঙালি হিন্দুকে রাষ্ট্র ভাগ করেছে চার শ্রেণিতে (চারের আঁটুনি)। পশ্চিমবঙ্গে এই চারটি শ্রেণি হচ্ছে: (ক) তফশিলি উপজাতি (৪১টি), (খ) তফশিলি জাতি (৬৩টি), (গ) অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণি অথবা ‘আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস (১৭৭টি) এবং (ঘ) এই তিনের বহির্ভূত অন্যান্য তথাকথিত বৰ্ণহিন্দু।

জাতিবিন্যাসের এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যাক কিভাবে ব্রাহ্মণ্য সমাজ এই কু-প্রথাটিকে চালু ও দৃঢ়মূল করে। সামাজিক ইতিহাসে দেখা যায় ব্রাহ্মণরা এটি করতে গিয়ে অন্তত তিনটি অস্ত্র ব্যবহার করে। এই তিনটি অস্ত্র হচ্ছে: ১. কায়স্থ জাতির সৃষ্টি, ২.ব্যবসায়ীদের হেনস্তা ও ৩. নাথ সম্প্রদায়ের অবনমন।

নিচে এই সম্বন্ধে আলোচনা করা হল:

১. কায়স্থ জাতির সৃষ্টি: আমরা জানি হিন্দুর চার বর্ণে ‘কায়স্থ’ বলে কোনো বর্ণ বা জাতি নেই। বাংলার ইতিহাসে নিকট অতীত অর্থাৎ পাল অথবা সেন আমলেও ‘কায়স্থ’ বলে কোনো সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল না। এই সম্প্রদায়টির বিকাশ ও আলাদা সম্প্রদায় হিসেবে এর স্বীকৃতি ঘটেছে অনেক পরে। কিভাবে এটি ঘটেছে এর একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যাক। দেখা যায় ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণে’ উল্লেখিত ‘করণ’ বা কেরাণি শ্রেণির লোকেরাই পরবর্তীকালে চাকরি সূত্রে অর্থবলে বলীয়ান হয়।

আজকের দিনের কেরাণিকুল যেভাবে অবৈধ পন্থায় অর্থ ও সম্পত্তির মালিক হয় সেই কালেও তারা যে একইভাবে অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছিল তা অনুমান করা যায়। এই বিত্তবান কেরাণিকুলের সাথে যোগ হয় বৌদ্ধ সমাজের ব্যবসায়ী শ্রেণি। অর্থ-বিত্তে বলীয়ান এই দুই শ্রেণিকে ব্রাহ্মণ্যসমাজ তাদের ঠিক নিচে স্থান করে দিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করে। অনেকের ধারণা বস্তুত বৌদ্ধ সমাজের ব্যবসায়ী শ্রেণির লোকেরাই পরবর্তীকালের ‘কায়স্থ’। কারণ দেখা যায় ‘কায়স্থরা’ যে পদবিগুলো ব্যবহার করে এগুলো বৌদ্ধ আমলের লোকনামের শেষাংশ।

অন্নদাশঙ্কর রায় তাই এদেরকে বৌদ্ধ বলে চিহ্নিত করতে আগ্রহী (প্রবন্ধ: আত্মদীপ প্রবোধচন্দ্র গ্রন্থ: নতুন করে ভাবা: দে’জ পাবলিশিং: ১৯৯৯)। কিন্তু লক্ষণীয় তাদেরকে ‘ক্ষয়িত্র’ মর্যাদা দেওয়া হয়নি। তাদেরকে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে ‘কায়স্থ’ হিসেবে।

বর্তমানকালে বিত্তবান ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীরা রাজনৈতিক দলগুলোতে যেভাবে পুরোনো কর্মীদের ডিঙ্গিয়ে ওপরে স্থান করে নিচ্ছে ঠিক একই প্রক্রিয়ায় যে ‘কায়স্থ’ ও বৈদ্যরা হিন্দু সমাজের ওপরে স্থান করে নিয়েছে তা ভাবতে অসুবিধা হয় না। এমতাবস্থায় এটি বললে কি ভুল হবে যে, মধ্যযুগের ‘করণ’দের অনুকরণেই পশ্চিমবঙ্গের সরকারী অফিসের নাম ‘মহাকরণ’ রাখা হয়েছে। ‘কায়স্থ’ সম্প্রদায়টি বস্তুত একটি ‘অমনিবাসের’ মত। এই ‘অমনিবাসে’ পদবি পরিবর্তনসহ নানা প্রক্রিয়ায় যে কোনো সম্প্রদায়ের লোক আশ্রয় নিতে পারে।

বস্তুত ১৯১১ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত সময়ে পরিচালিত চারটি লোকগণনার সময় সমাজের নানা জাতির লোক ‘কায়স্থ’ বলে নিজেদেরকে নথিবদ্ধ করিয়ে নিয়েছে। লক্ষণীয় এর ফলে ‘কায়স্থ’ জাতির লোকের সংখ্যা ১৯১১-১৯৪১ সালের মধ্যে অন্যান্য জাতির লোকের সংখ্যা থেকে মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পায়।

পুরোনো এই প্রক্রিয়া আজও চালু আছে। ‘কায়স্থ’দের এই গুণ সম্বন্ধে খুব ভাল বর্ণনা দিয়েছেন খুশবন্ত সিং (পেঙ্গুইন: ১৯৯০: দিল্লী)। তিনি তাঁর গ্রন্থের ‘মুসদ্দী লাল’ অধ্যায়ে ‘কায়স্থরা’ কখন ও কিভাবে ‘কমল’ (হিন্দু) অথবা ‘কামাল’ (মুসলমান) হয় তার নিখুঁত একটি বর্ণনা দিয়েছেন। পাত্রভেদে এদের এই রং পরিবর্তন ব্রাহ্মণ্য সমাজকে করছে পরিপুষ্ট। এর প্রতিদানে ব্রাহ্মণও করছে তাকে সমর্থন। প্রধানত এই দুইয়ে মিলেই গড়ে তুলেছে হিন্দু সমাজের জাতিভেদ নামক অচলায়তন।

২. ব্যবসায়ীদেরকে হেনস্তা: ব্যবসায়ী অথবা বৈশ্য সম্প্রদায়ের লোকদের শ্রেণি বিন্যাসের নামে কিভাবে হেনস্তা করা হয তার কিছু কিছু আলামত পাওয়া যায় নানা কুলজী গ্রন্থে। এসব গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি যে, বল্লাল সেন সুবর্ণবণিকদের প্রতি খুশি ছিলেন না। কারণ যুদ্ধের জন্য তারা বল্লালকে টাকা ধার দেয়নি। তাই সুবর্ণবণিকরা বল্লালের কোপদৃষ্টিতে পড়েন।

এ প্রেক্ষাপটেই শ্রেণিবিন্যাসে সুবর্ণ বণিকদের স্থান হয় সমাজের নিচে। এছাড়াও দেখা যায় ব্যবসায়ীদেরকে বৈশ্য শ্রেণিভুক্ত তো করাই হয়নি, বরং তাদেরকে করা হয়েছে বহুধা বিভক্ত। এটি একটি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা বলে মনে হয়। কারণ বৈশ্যরা ছিল বৌদ্ধ ধর্মানুসারী।

বস্তুত তাদের সমর্থনেই বৌদ্ধধর্ম বিকাশ লাভ করে। মধ্যযুগে বৈশ্যদের সামাজিক অবস্থান কত দৃঢ় ছিল তা চাঁদ সওদাগরের কাহিনী থেকেই বোঝা যায়। চাঁদ সওদাগর ছিলেন শিবের ভক্ত। ব্রাহ্মণ সৃষ্ট মনসা তার কাছ থেকে পূজা চান। কিন্তু চাঁদ সওদাগর অস্বীকৃত হলে তার ওপর নেমে আসে উৎপীড়ন ও নির্যাতন। তার ব্যবসার ক্ষতিসাধন করা হয়। শেষ পর্যন্ত চাঁদ সওদাগর মনসার পূজা করেন বাঁ হাতে। তাও মনসাকে শিবের কন্যা হিসেবে ঘোষণার পর। এইরকম ক্ষমতাশালী সম্প্রদায়কে সামাজিক ও আর্থিকভাবে দুর্বল করতে না পারলে ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিকাশ (জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব) সম্ভব ছিল না।

সেইজন্য ব্যবসায়ীদেরকে সামাজিক বিন্যাসে শুধু বহুধা বিভক্তই করা হয়নি তাদেরকে জায়গা দেওয়া হয় বাঙালি হিন্দু সমাজের নিচে। পাশাপাশি নিষিদ্ধ করা হয় সমুদ্র যাত্রা। সমুদ্র যাত্রাই বৈশ্যদের ধনোপার্জনের উপায়। এটি বন্ধ করার মাধ্যমে বৈশ্যদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা খর্ব করার পর্ব নিরঙ্কুশ করা হয়।

৩. নাথ সম্প্রদায়ের অবনমন: ‘কায়স্থ’ নামীয় ‘অমনিবাস’ সৃষ্টি ও বৈশ্যদের হেনস্তার পাশাপাশি আরও একটি প্রবল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে মারাত্মকভাবে আহত করার মাধ্যমে জাতিভেদ প্রথাটির ভিত্তি রচনা করা হয়। এই সম্প্রদায়টি হচ্ছে বাঙালি হিন্দু সমাজের বর্তমান সম্প্রদায়।

এটি গড়ে ওঠেছিল বৌদ্ধধর্মের পতনকালে। বৌদ্ধতন্ত্র ও হিন্দুতন্ত্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই ধর্মীয় মতটি খ্রিস্টীয় ৭ম থেকে নবম/দশম শতাব্দী পর্যন্ত খুবই শক্তিশালী ছিল। আজকের দিনেও ‘নাথ সাহিত্য’ আলাদাভাবে বাংলা সাহিত্যে স্থান করে আছে। এরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিস্তার ও বিকাশে ছিল প্রবল ধর্মীয় বাধা।

লক্ষণীয় ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণে’ (দ্বাদশ-ত্রয়োদশ) ‘নাথ বা যোগী’ সম্প্রদায়ের কোনো স্থান নেই। তার অর্থ তারা তখনও ব্রাহ্মণ্য সমাজকে স্বীকার করতে রাজি হয়নি। পরবর্তীকালে অবশ্য ‘ধর্মপুরাণে’ (ষোড়শ শতাব্দী) এদের উল্লেখ দেখে মনে হয় তারা ততদিনে ‘হিন্দু’ সমাজভুক্ত।

ধর্মমত হিসেবে নাথ অথবা সন্ন্যাসী-যোগী জাতির অবমাননা, কায়স্থ জাতির সৃষ্টি এবং বিত্তবান বৈশ্যদের ওপর আক্রমণের মধ্য দিয়েই শুরু হয় জাতি ভিত্তিক (কাস্ট) ব্রাহ্মণ্যধর্মের উত্থান।

বলা বাহুল্য এই উত্থান একটি বর্ণবাদী ব্যবস্থার উত্থান। কিভাবে তা সম্ভব হয়েছে এর একটি ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা ওপরে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন: বাঙালি হিন্দুর সামাজিক ও ধর্মীয় এই অসম ও বর্ণবাদী ব্যবস্থা ‘জাতির’ (কাস্ট) নামে কি করে এখনও টিকে আছে?

এর চারটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। প্রথমত, এই জাতি ভিত্তিক শ্রেণি বিন্যাসটির মূল ভিত্তি হচ্ছে বৈষম্য। সাধারণভাবে মানুষ বৈষম্য পছন্দ করে না। তাই বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম নিরন্তর। কিন্তু বাস্তবে মনে হয় মানুষ বৈষম্যেরই অনুসারী। দেখা যায় নিচে থাকলে মানুষ বৈষম্য বিরোধী হয়, আবার যতই সে ওপরে ওঠে ততই সে বৈষম্যকামী হয়ে উঠে। মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষের ইতিহাস বৈষম্যেরই ইতিহাস।

দ্বিতীয়ত, হিন্দু সমাজের এই বৈষম্যভিত্তিক ব্যবস্থা পারস্পরিক। বহু জাতি ওপর নিচ এই ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ। তাই প্রত্যেকেই মনে করে যে, সে অন্তত অনেকের ওপরে আছে। এতেই তার স্বস্তি বা আত্মতৃপ্তি।

তৃতীয়ত, এই বৈষম্যভিত্তিক সমাজের বিরুদ্ধে অনেকেই প্রতিবাদ করতে পারে। কিন্তু করে না। কারণ সামাজিক কাঠামোতে প্রতিবাদী অংশের ওপরে উঠার ব্যবস্থা আছে। পদবি, স্থান, বৃত্তি, আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ও শিক্ষা লাভের মাধ্যমে একজন তথাকথিত নিচু সম্প্রদায়ের লোক উঁচু সম্প্রদায়ে স্থান করে নিতে পারে। ব্রাহ্মণ্য সমাজ এই পরিবর্তনে আপত্তি করে না। কারণ তারা জানে এই ধরনের ব্যবস্থা না থাকলে প্রতিবাদের মুখে পুরো ব্যবস্থা ধসে পড়তে পারে।

চতুর্থত, আগে কৌলীন্য ছিল জন্মভিত্তিক। এই জন্ম কৌলীন্যের সাথে এখন যোগ হয়েছে শিক্ষাকৌলীন্য বিত্তকৌলীন্য ও চাকরি বা পেশা সূত্রে প্রাপ্ত প্রশাসনিক ক্ষমতার কৌলীন্য। ঘটনাক্রমে ব্রাহ্মণ্য সমাজ (ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য) বিগত কয়েক শতক যাবত এই কৌলীন্যগুলোকে একচেটিয়াভাবে ভোগ করে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। এসব কারণেই মনে হয় জাতিভিত্তিক জাতিভেদ প্রথা এখনও টিকে আছে।

বলা বাহুল্য এই প্রথাটি পৃথিবীর প্রাচীনতম ‘বর্ণবাদ’ (অ্যাপারটইট) (অন্নদাশঙ্কর রায়: গ্রন্থ: সংহতির সংকট: প্রবন্ধ: স্পৃশ্যাস্পৃশ্য বিনিশ্চয়: বাণী শিল্প: দ্বিতীয় সংস্করণ: ১৯৯৯)।

এখানে উল্লেখ্য এই চার কারণের বাইরেও একটি কারণ আছে। সম্ভবত এটিই সবচেয়ে বড় কারণ। দেখা যায় বর্ণবাদী বাঙালি হিন্দু সমাজের অত্যাচার ও নিপীড়নের প্রতিবাদ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক এ সমাজ থেকে বেড়িয়ে যায়। তারাই আজকের দিনের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী ধর্মাবলম্বী মানুষ। অনুমান করা যায় তারা বেরিয়ে না গেলে এতদিনে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে বর্ণবাদী ব্যবস্থা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেত। অসম্ভব নয় যে ব্রাহ্মণ্যসমাজ তাই চেয়েছিল। কারণ ফড়িয়া সম্প্রদায় হিসাবে প্রাধান্য রক্ষার আর কোনো পন্থা তাদের জানা ছিল না।

৩৪ জাতিভিত্তিক এই ব্রাহ্মণ্য সমাজ ব্যবস্থা হিন্দুর যে কত ক্ষতি করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাই এর কুফল সম্পর্কে হিন্দু মনীষীগণ বারবার সাবধান করে দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ স্বামী বিবেকানন্দের কথা বলা যায়। তিনি বলেছেন: যদি প্রয়োজন হয় সমাজ ব্যবস্থার উন্নতি কর, বিধবাদের বিয়ে দাও। জাতিভেদ প্রথার মাথায় বাড়ি মারো। আবার এসব ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের বাড়াবাড়িতে তিনি ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিলেন। পরিবর্তন বিরোধী বর্ণহিন্দুদেরকে তিনি ১০,০০০ বছরের মমি হিসাবে আখ্যায়িত করেন (বিবেকানন্দ কথামৃত: ড. হরপদ চট্টোপাধ্যায়: বুলবুল প্রকাশন: ১৯৯৪)।

  • সূত্র: বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলিম, সামাজিক বিবর্তন।
  • ড. আর এম দেবনাথ

আরো পড়ুন>>

শেয়ার করে সবাইকে পড়ার সুযোগ দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!