শ্রীলংকাবাসীর উদারতায় মুগ্ধ

শ্রীলংকাবাসীর উদারতায় মুগ্ধ: আমি প্রথম শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে যাই ১১ মার্চ ২০১৫ সাল। যোগাযোগের সুবিধার্থে ভারতের চেন্নাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কলম্বো যাত্রা করি। খুব বেশি সময় লাগে নি। ভারত মহাসাগর পাড়ি দিতেই নারিকেল গাছ সমেত লঙ্কা দ্বীপ আকাশ থেকেই দেখা যায়। প্রথম ভ্রমণ, অনেক কৌতুহল! সাগরের সৌন্দর্য মণ্ডিত দ্বীপ দেখতে না দেখতেই অবতরণের সময় হয়েছে বলে বিমান বালার ঘোষণা।

ড. সুমনপ্রিয় ভিক্ষু

যথারীতি নেমে ইমিগ্রেশনে যেতেই বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে কত সম্মান জানানো হয়েছে, তা দেখে আমি অভিভূত। মনে করেছিলাম অন্যান্য বিমানবন্দরের মত ইমিগ্রেশন অফিসের বাইরে মানি একচেঞ্জের দোকান পাব, সেখান থেকে ডলার চেঞ্জ করে নেব তাই ইমিগ্রেশন অফিসের ভেতরে থাকা দোকান থেকে চেঞ্জ না করেই বাইরে চলে আসি।

বাইরে এসে কাছে কোন মানি চেইঞ্জের দোকান পেলাম না, এদিক সেদিক অনেক খুঁজে দেখলাম, আমার পাশে দাঁড়ানো এক শ্রীলঙ্কান ভদ্র লোক, তাকে জিজ্ঞেস করলাম আশেপাশে কোন মানি চেঞ্জের দোকান আছে কিনা। তিনি বললেন ইমিগ্রেশনের ভেতরে এবং বাইরে আরও কিছু দূরে দোকান রয়েছে।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথায় যাব? বললাম আমি বন্ধুর কাছে যাব, ঠিকানাটা তাকে বললাম।

তিনি বুঝতে পেরেছেন সেখান থেকে অনেক দূর আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ”নিতে আসবে কি কেউ?” বললাম, ”আসার কথা কিন্তু আমার মোবাইল নাই যোগাযোগ করতে পারছি না।” নাম্বার আছে কিনা জিজ্ঞেস করে তার মোবাইল থেকে কল দিলেন, বন্ধু বললেন সেদিন তার পরীক্ষা থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে।

ভদ্রলোক বললেন, ”আমি আমার মা বাবাকে নিতে এসেছি, আপনি যেই বিমানে এসেছেন তারাও চেন্নাই হতে একই বিমানে এসেছে, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন, আমিও একই রাস্তা দিয়ে যাব, আমার গাড়ি আছে, আপনাকে ডলার চেঞ্জ করতে হবে না। বাকি রাস্তা যেতে যা লাগে তা আমি দান করব!”

তার কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তার মা-বাবা ইমিগ্রেশন শেষ করে বেরিয়ে এসেছেন। তাদের দেখেই বুঝতে পারলাম তারা বিমানে আমার সামনের সিটে ছিলেন।

ভদ্রলোক বললেন, ”আমরা এখন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত চলেন।” বন্দনাসহকারে ডেকে গাড়িতে তুলে নিলেন। নিজেই কার চালিয়ে যেতে শুরু করলেন।

শ্রীলংকাবাসীর পাশে দাড়ালো বৌদ্ধ সংগঠন BDCHK

জানতে পারলাম তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসা করেন, দেশে এসে মা-বাবাকে ভারতে পুণ্য তীর্থ দর্শনে পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার বহু বিষয়ে আলাপ করতে করতে প্রায় ১ ঘন্টারও বেশি সময় পর আমি যে ঠিকানায় যাব সেখানে যাওয়ার জন্য আরও একটা গাড়ি নিতে হবে বললেন। ওনারা অন্য রাস্তা দিয়ে যাবেন।

সেখান থেকে আমার ঠিকানায় পৌঁছাতে যত টেক্সি ভাড়া লাগবে ততটুকু হিসাব করে আরও কিছু বাড়িয়ে আমাকে কিছু শ্রীলঙ্কান টাকা দান করে একটা টেক্সি ভাড়া করে দিলেন। তারপর ২০/৩০ মিনিট পরে বন্ধুর ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম।

বন্ধু ভিক্ষু মোগ্যালায়ন  ও তার অন্যান্য বন্ধুসহ অনেক আতিথ্য দানের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করাল। শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ পর্বত নুয়েরিলাও নিয়ে গিয়েছিল, যেখানে বিশ্ববিখ্যাত Macwoods Museum, চা বাগান, চা শিল্প কারখানা পরিদর্শন করলাম যা অসাধারণ দৃশ্য।

সেখানে একজন বাংলাদেশী পাহাড়ি মার্মা ভিক্ষু পেয়েছিলাম যিনি স্কুলে শিক্ষকতা করেন, ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান করেন।

প্রথম শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের এই অভিনব অভিজ্ঞতা কখনো ভুলবার নয়। তাদের আন্তরিকতা, উদারতা, শ্রদ্ধাবোধ, আতিথেয়তা সত্যি অসাধারণ।

কয়েকদিন বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে দেখতে পেলাম তাদের পুণ্য চেতনা, সহজ সরল জীবন যাপন। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বেশিরভাগই মানুষের গায়ের রঙ শ্যামলা, শ্যামলা হলেও চেহারা খুব মাধুর্যপূর্ণ। পুরুষদের সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, মহিলাদের বিশেষ সাঁজের শাড়ি, শাড়ি পরার বিশেষ স্টাইল সবাইকে মুগ্ধ করে। দৈনিক কাজের প্রতি খুবই নিয়মানুবর্তী হয়ে চলে শ্রীলঙ্কানরা।

সঙ্গত কারণে আজ শ্রীলঙ্কার অবস্থা খুবই শোচনীয়। স্কুল-কলেজ বন্ধ হতে চলেছে। বিভিন্ন দেশ সহানুভূতি প্রকাশ করে সহযোগিতা করছে। বাংলাদেশ থেকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। জেনে ভালো লাগতেছে যে, বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উদ্যোগে সাহায্যের জন্য বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ও পূজনীয় ভিক্ষু সংঘও কাজ করছেন। আসুন আজ এই দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়াই। মানবতাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম!

বন্ধু মোগ্যালায়ন  যিনি বাংলাদেশের অত্যন্ত সুপরিচিত কদলপুর ভিক্ষু শ্রামণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষার্থী ছিল। বর্তমানে উচ্চতর শিক্ষার জন্য হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছেন। সেখানে অনেক বাংলাদেশী ভিক্ষুদের সাথে সাক্ষাৎ, ঘোরাঘুরি খুবই চমৎকার ছিল, সবার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করছি।

পরিশেষে সবার জয়মঙ্গল কামনা করছি।

কলাম লেখক-
ড. সুমনপ্রিয় ভিক্ষু
তথ্য ও প্রযুক্তি সচিব, বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা; সাধারণ সম্পাদক, চন্দনাইশ ভিক্ষু পরিষদ; উপ বিহারাধ্যক্ষ, সাতবাড়ীয়া বেপারীপাড়া রত্নাঙ্কুর বিহার।
শেয়ার করে সবাইকে পড়ার সুযোগ দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!