বুদ্ধের লাভান্তরায়। (মিলিন্দপ্রশ্ন)

বুদ্ধকে একদিন পিন্ডাচরনের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণগ্রামে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছিল। কিন্তু বুদ্ধগণ সর্বজ্ঞ বুদ্ধগণ কোন দিনের কি পরিনতি জানতে পারেন। কিন্তু কেন সেদিন ব্রাহ্মণগ্রাম থেকে ধৌত পাত্রে ফিরে আসতে হয়েছিল।

রাজা মিলিন্দ বিষয়টি নিয়ে নিজর মধ্যে সন্দেহের বীজ বপন করেন। তিনি নাগসেন ভান্তেকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করেন। ভান্তে নাগসেন রাজা মিলিন্দকে উদাহরণ সহ বিষয়টি ব্যাখা করেন।

চলুন পড়ে আসি কেন সেদিন বুদ্ধ ব্রহ্মণগ্রাম থেকে খালি হাতে ফিরে এসেছিলেন।

“ভন্তে নাগসেন! আপনারা বলিয়া থাকেন‘তথাগত চীবর, পিণ্ডপাত, শয়নাসন ও রোগাবস্থায় বাঞ্ছিত আবশ্যকীয় দ্রব্য সমূহ লাভ করিতেন।’ আবার বলিয়া থাকেন‘তথাগত পঞ্চশাল ব্রাহ্মণগ্রামে ভিক্ষা পিন্ডের জন্য প্রবেশ করিয়া কিছু লাভ করেন নাই, যথা-ধৌত পাত্রে ফিরিয়া আসিয়াছেন।’

যদি ভন্তে! ‘তথাগত—আবশ্যকীয় দ্রব্য সমূহ লাভ করিতেন’ তবে‘পঞ্চশাল ব্রাহ্মণগ্রামে কিছু লাভ করেন নাই’ এই যে কথা, তাহা মিথ্যা! আর যদি পঞ্চশাল ব্রাহ্মণগ্রামে কিছু লাভ করেন নাই; তবে তিনি‘আবশ্যকীয় দ্রব্য সমূহ লাভ করিতেন’ এই যে কথা, তাহা মিথ্যা। ইহাও সুমহান্ দুঃসাধ্য উভয় কোটিক প্রশ্ন আপনার সমীপে উপস্থাপিত হইয়াছে। আপনাকে ইহা নিষ্পত্তি করিতে হইবে।”

মহারাজ! —-এই উভয় বাণী সত্য। কিন্তু পঞ্চশাল ব্রাহ্মণগ্রামে যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা পাপী হইলে মারের জন্যই হইয়াছিল।”

“ভন্তে! তাহা হইলে ভগবানের গণনাপথাতীত কল্পে সঞ্চিত পুণ্য সেই সময় কি শেষ হইয়াছিল? অধুনা উৎপন্ন পাপী মার দ্বারা সেই পুণ্য কর্মের বল- বেগ কি রুদ্ধ হইয়াছিল? তাহা হইলে ভন্তে! সেই ঘটনায় দুই কারণে অপবাদ আসে পুণ্য অপেক্ষা পাপ বলবত্তর হয়। বুদ্ধবল অপেক্ষাও মারবল অধিকতর হয়। যদি তাহা হয় তবে বৃক্ষের মূল অপেক্ষা অগ্রভাগই অধিকতর ভারী হয়, এবং গুণবান অপেক্ষা অতিপাপী বলবান হয়!”

“মহারাজ! মাত্র তাহাতেই পুণ্য অপেক্ষা পাপ বলবান হইতেই পারে না। বুদ্ধবল অপেক্ষা মারবল অধিক হইতে পারে না। অথচ এই ক্ষেত্রে এক কারণ জানিতে হইবে।

মহারাজ! যদি কোন লোক মধু, মধুচক্র অথবা অন্য কিছু উপহার লইয়া চক্রবর্তী রাজার নিকট উপস্থিত হয়, রাজার দ্বারপাল তাহাকে বলে-‘ওহে। রাজদর্শনের ইহা অসময়। সুতরাং রাজা দণ্ড বিধান করিবার পূর্বেই তোমার উপহার লইয়া শীঘ্র-শীঘ্র ফিরিয়া যাও।’ তখন সেই লোক দণ্ড ভয়ে ভীত ও উদ্বিগ্ন হইয়া সেই উপহার লইয়া অবিলম্বে ফিরিয়া যায়। মহারাজ! তবে কি এই মাত্র উপহার বিকলতার দরুণ চক্রবর্তী রাজা দ্বারপাল অপেক্ষা দুর্বলতর হয়?

রাজার কি অন্য কিছু উপহার লাভ হয় না?”

“না, ভন্তে! ঈর্ষা বশতঃ সেই দ্বারপাল ঐ উপহার বন্ধ করিয়াছিল। কিন্তু অপর দ্বার দিয়া তদপেক্ষা শত-সহস্র গুণ উপহার রাজার নিকট উপনীত হয়।”

“মহারাজ! এই প্রকারেই, স্বীয় ঈর্ষাস্বভাব হেতু পাপী মার পঞ্চশালের ব্রাহ্মণ গৃহপতিদিগকে আবিষ্ট করিয়াছে। কিন্তু অপর পক্ষে অনেক শত-সহস্র দেবগণ দিব্য-ওজঃ সম্পন্ন অমৃত লইয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন যে‘আমরা ভগবানের দেহে বলাধান করিব।’ এই মনে করিয়া ভগবানকে যুক্তাঞ্জলি প্রণাম করিয়া দাঁড়াইলেন।”

“ভন্তে নাগসেন! জগতে সর্বোত্তম মানব ভগবানের চতুর্বিধ আবশ্যকীয় দ্রব্য সুলভ হউক, এবং দেবমনুষ্য কর্তৃক প্রার্থিত হইয়া ভগবান চারি আবশ্যকীয় দ্রব্য ভোগ করুন। কিন্তু মারের যে ইচ্ছা ছিল এতদ্বারা তাহা পূর্ণ হইল নহে কি?

কেননা সে ভগবানের ভোজনের অন্তরায় করিয়াছিল। ভন্তে! এ বিষয়ে আমার সন্দেহ ভঞ্জন হইতেছে না। তাহাতে আমার বিমতি জন্মিয়াছে, আমি সংশয়াপন্ন হইয়াছি। তাহাতে আমার মন অগ্রসর হইতেছে না যে, দেবলোকসহ এই (মনুষ্য) লোকে অগ্রগণ্য পুরুষবর, কুশল ও উত্তম পুণ্যসম্ভাবনা যুক্ত, অনুপম, অসমসম, অপ্রতিসম তথাগত অর্হৎ সম্যক্ সম্বুদ্ধের ন্যায় মহাপুরুষের অনুপম, অসমসম, অপ্রতিসম তথাগত অর্হৎ সম্যক্ সম্বুদ্ধের ন্যায় মহাপুরুষের তুচ্ছ, হীন, সামান্য, পাপমতি অনার্য ও বিপন্ন মার প্রয়োজনীয় দ্রব্য লাভের অন্তরায় করিল?”

”মহারাজ! দানের চারি প্রকার অন্তরায় অদৃষ্টান্তরায়, উদ্দেশকৃতান্তরায়, প্রস্তুতিকৃতান্তরায় পরিভোগান্তরা”।

  • তন্মধ্যে অদৃষ্ট অন্তরায় কি প্রকার? কাহাকেও উদ্দেশ বা দর্শন করিয়া দান প্রস্তুত হয় নাই। (গ্রহীতা পাইলেই দান দিবে এইজন্যই দানসামগ্রী প্রস্তুত হইয়াছে) এই অবস্থায় কেহ যদি এই বলিয়া বিঘ্ন উৎপাদন করে যে‘পরকে দান করিয়া কি লাভ’ইহা অদৃষ্টান্তরায়।
  • উদ্দেশকৃত অন্তরায় কি? কোন ব্যক্তি বিশেষকে দেখিয়া তাঁহার উদ্দেশ্যে ভোজন প্রস্তুত হয়, তখন কেহ যদি তাহাতে বিঘ্ন উৎপাদন করে ইহা উদ্দেশ্যকৃতান্তরায়।
  • প্রস্তুতিকৃতান্তরায় কি? এখানে কোন দানীয় বস্তু সজ্জিত হইয়াছে, এখনও গচ্ছিত হয় নাইÍএই অবস্থায় কেহ যদি বিঘ্ন উৎপাদন করে ইহা প্রস্তুতিকৃতান্তরায়।
  • পরিভোগান্তরায় কি? দান প্রাপ্ত হইয়া গ্রাহক তাহা ভোগ করিতে উদ্যত হইয়াছে, এমন অবস্থায় কেহ যদি বিঘœ উৎপাদন করে ইহা পরিভোগান্তরায়।

মহারাজ! এই চারি প্রকার অন্তরায়। পঞ্চশালবাসী ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিগণকে পাপমতি মার যে আবিষ্ট করিয়াছে। ভগবানের সেই পরিভোগ তাঁহার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত ছিল না, উহা অনাগত, অনুপস্থিত বুদ্ধকে অদর্শন হেতু অন্তরায় করা হইয়াছিল। তাহা কিন্তু একমাত্র ভগবানের নহে, অথচ সেই সময় যাহারা ভিক্ষায় বাহির হইয়াছে, কিংবা অতিথি আসিয়াছে, তাহারা সকলেই সেইদিন ভোজন লাভ করে নাই।

মহারাজ! দেবতা, মার, ব্রহ্মা, শ্রমণ, ব্রাহ্মণ তথা সমস্ত জীবের সহিত এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে এমন কাহাকেও আমি দেখি না যে ব্যক্তি বুদ্ধের উদ্দেশ্যে কৃত লাভের অন্তরায় করিতে পারে; যদি কেহ ঈর্ষা প্রণোদিত হইয়া বুদ্ধের উদ্দেশ্যে কৃত, সজ্জিত দ্রব্যেরও পরিভোগের অন্তরায় করে তবে তাহার শির শতভাগে বা সহস্রভাগে বিদীর্ণ হয়।”

“মহারাজ! বুদ্ধের এই চারি প্রকার গুণ আছে, যাহা কাহারও দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হয় না। সেই চারি প্রকার গুণ কি কি? মহারাজ! বুদ্ধের উদ্দেশ্যে কৃত ও সজ্জিত দ্রব্যের কেহ অন্তরায় করিতে পারে না। তাঁহার শরীরস্থ ব্যাম (সাড়ে তিন হাত) পরিমাণ প্রভাব কেহ বিঘ্ন জন্মাইতে পারে না। তাঁহার সর্বজ্ঞতা জ্ঞানরত্নের কেহ অন্তরায় করিতে পারে না এবং কেহ ভগবানের জীবনের অন্তরায় করিতে পারে না। মহারাজ! বুদ্ধের এই চারি প্রকার গুণ আছে, যাহা কাহারও দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হয় না। এই সমস্ত গুণ একরস, অব্যাহত, অক্ষুব্ধ; পরোপক্রমদ্বারা ইহারা স্পৃষ্ট হয় না, ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। মহারাজ! পাপমতি মার অদৃশ্যভাবে লুক্কায়িত থাকিয়া পঞ্চশালবাসী ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিদিগকে আবিষ্ট করিয়াছিল।

যেমন, মহারাজ! কোন রাজার দুর্গম সীমান্ত দেশে চোরগণ অদৃশ্যভাবে আত্মগোপন করিয়া পথিককে আক্রমণ করে। যদি রাজা তাহাদিগকে দেখিতে পায় তবে কি চোর স্বস্তি লাভ করিবে?”

“না, ভন্তে! তাহা হইলে রাজা তাহাদিগকে শত বা সহস্র খন্ডে ছেদন করাইতে পারেন।”

“মহারাজ! এই রূপেই পাপমতি মার অদৃশ্যভাবে আত্মগোপন করিয়া পঞ্চশালবাসী ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিদিগকে আবিষ্ট করিয়াছিল।

অথবা মহারাজ! যেমন কোন সধবা নারী অদৃশ্যভাবে আত্ম-গোপন করিয়া পরপুরুষ সেবা করে, সেইরূপ পাপমতি মার অদৃশ্যভাবে সেইরূপ আত্মগোপন করিয়া ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিদিগকে আবিষ্ট করিয়াছে। মহারাজ! যদি সেই সধবা নারী স্বামীর সম্মুখে পরপুরুষ সেবা করে তবে কি সেই স্ত্রীর স্বস্তি লাভ হইবে?”

“না, ভন্তে! স্বামী ইচ্ছা করিলে তাহাকে প্রহার করিতে পারে, বধ করিতে পারে, বন্ধন করিতে পারে কিংবা দাসীত্বে পরিণত করিতে পারে।”

“মহারাজ! এই রূপেই, পাপমতি মার অদৃশ্যভাবে আত্ম-গোপন করিয়া পঞ্চশালবাসী ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিদিগকে অভিভূত করিয়াছিল। মহারাজ! যদি পাপী মার ভগবানের উদ্দেশ্যে কৃত, তাঁহার জন্য সজ্জিত, ভোজনোদ্যত ভোগের বিঘ্নঘটাইত, তবে তাহার শির শতভাগে কিংবা সহস্রভাগে বিভক্ত হইত।”

“হাঁ, ভন্তে নাগসেন! পাপমতি মার এই প্রকারে চৌর্যভাবে ইহা করিয়াছে; পাপী মার আত্মগোপন করিয়া পঞ্চশালবাসী ব্রাহ্মণ ও গৃহপতিদিগকে আবিষ্ট করিয়াছে। যদি ভন্তে! সেই পাপী মার ভগবানের উদ্দেশ্যে কৃত, তাঁহার জন্য সজ্জিত দ্রব্যের ও উপভোগের অন্তরায় করিত তবে উহার শির শতভাগে বা সহস্রভাগে বিভক্ত হইত। অথবা তাহার দেহ ভুষি মুষ্টির ন্যায় বিকীর্ণ হইত।

উত্তম, ভন্তে নাগসেন! ইহা এইরূপ, আমি তদ্রƒপেই স্বীকার করিতেছি।”

আরো পড়ুন>>

বৌদ্ধ বার্তা

শেয়ার করে সবাইকে পড়ার সুযোগ দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!