আজ সেই ২৯ সেপ্টম্বর, রামু বৌদ্ধ বিহার আক্রমণের দিন। গভীর উদ্বেগের সাথে এই দিনটিকে স্মরণ করছে কক্সবাজার তথা সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধরা।
আজ থেকে ৯ বছর আগে আজকের এই দিনে বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর একটি পৈশাচিক অশুভ শক্তি ভর করেছিল।
কি কারণে এই হামলা?
কোন এক উত্তম বড়ুয়ার ফেইজবুক পোষ্টের সূত্র ধরেই ঘটনার অবতারনা। পরে ঘটনাটি প্রমাণিত হয়েছিল কোন একজন উত্তম বড়ুয়ার প্রোফাইলে ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে মর্যদাপূর্ণ ও আল্লাহ প্রদত্ত গ্রন্থ পবিত্র কোরান শরীফের উপর পা রাখা অবস্থার একটি ছবি ট্যাগ করে।
ছবিটি তার ফেইজবুকের অন্যান্য বন্ধুরা দেখলে প্রকৃত অপরাধীকে না খুজে যাকে ট্যাগ করা হয়েছে অর্থাৎ উত্তম বড়ুয়া তথা তার চৌদ্দগুষ্টি, জাতী-উপজাতী নির্মূল করার উৎসবে মেতে উঠে একদল ধর্মান্ধ বিবেকহীন দুই পা ওয়ালা প্রাণী। পরে প্রমাণিত হয়েছে ছবিটি তার কোন এক অপরিচিত ফেইজবুক বন্ধুই তার প্রোফাইলে ট্যাগ করেছিল।
ঘটনা পরিকল্পিত কিনা?
ঘটনাটি সম্পূর্ণ পরিকল্পিত তা না বুঝার কোন অবকাশ নাই। কারণ, সেদিন ধ্বংস যজ্ঞে যেসব অস্ত্র ও রাসায়নিক ক্যামিক্যাল ব্যবহার করা হয়েছিল তা তৎক্ষনাত সাধারণ মানুষের হাতে পাওয়ার কথা নয়। মহুর্তেই গান পাউডার, শতশত লিটার পেট্রোল, কেরোসিন সাধারন উত্তেজিত মানুষের হাতে আসা কিভাবে সম্ভব। কিভাবে একযোগে রামু, উখিয়া, টেকনাফ, পটিয়তে হামলা হয়? এই থেকে তো ঘটনা পানির মতো পরিষ্কার, এটি একটি পূর্ব পরিকল্পিত, সাজানো হামলা।
যে জাতি সাধারন ফুলের পাপড়ি মাটিতে দেখলে কুঁড়িয়ে নিয়ে কপালে ঠেকায়, সাধারণ বই এর পাতা মাটি থেকে নিয়ে পকেটে পুরে সেই জাতি কেমনে অন্য ধর্মীয় গ্রন্থের উপর পা দিয়ে ছবি তুলে ফেইজবুকে পোষ্ট করার সাহস পায়? তাছাড়া এমন একটা কান্ড করলে প্রতিঘাত আসবে সেটা এই দেশের প্রতিটি মানুষ জানে। তাহলে সেই রকম একটা ঘৃণ্য কাজ করে আবার নিজের ফেইবুকে শেয়ার করবে কোন পাগলে?
কি হয়েছিল সেদিন?
এই বানোয়অট ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিভাবে দুর্বৃত্তরা প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারগুলোকে সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে আগুনে জ্বালিয়ে নষ্ট করেছে। কিভাবে সমগ্র কক্সবাজার জেলার প্রতিটি উপজেলা- রামু, উখিয়া, টেকনাফ এবং দেশের অন্যান্য স্থানে ধর্মের নামে ধর্মান্ধতার ধ্বংস যজ্ঞ চালানো হয়েছে, বিশ্ববাসী দেখেছে।
সেদিন ছিল পবিত্র মধু পূর্ণিমার রাত। শত শত হামলকারী বারুদ, পেট্রোল, কেরোসিন, লাঠি, খঞ্জর এবং অন্যান্য অনেক অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত হয়ে বৌদ্ধ বিহার ও জনগণের উপর জঘন্য হামলা চালায়।
শুধু ধর্মীয় স্থাপনায় আগুন দিয়ে তারা ক্ষান্ত থাকেনি, তারা গৃহস্থালিতেও অগ্নিসংযোগ করেছিল, বাড়িঘর লোটপাট সহ জিনিসপত্র ভেঙে দেয়। ভগবান বুদ্ধের পবিত্র মূর্তি ধ্বংস করে, রামু, উখিয়া, টেকনাফ এবং পটিয়ায় অনেক বৌদ্ধদের আহত করে। তারা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আমাদের অমূল্য ঐতিহ্য স্থানগুলোকে নির্বিচারে ধ্বংস করেছে।
এই ঘৃণ্য হামলায় আমরা ভগবান বুদ্ধের অমূল্য মূর্তি, আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, বুদ্ধের সংগৃহীত পবিত্র উপাদান (ধাতু) এবং অন্যান্য মূল্যবান পুরাকীর্তি হারিয়েছি। তিনশো বছরের পুরনো মঠ যা কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার সম্পূর্ণ চিরতরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এই প্রাচীন বিহার ঐতিহ্যগতভাবে রামু, কক্সবাজারের পর্যটনকে তার বিশিষ্টতা ও সুনামের সাথে সমৃদ্ধ করেছে। এটি ছিল বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহাসিকভাবে উল্লেখযোগ্য মঠ। এটি ছিল আমাদের আলোকিত বৌদ্ধ ঐতিহ্য এবং দেশের সংস্কৃতির উজ্জ্বল প্রতীক।
প্রাচীন নিদর্শন, প্রত্নসম্পদ, ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলি কেবল ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রেক্ষিতেই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না বরং ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে আমাদের সকলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাদের মূল্যবোধ ছিল অপরিসীম এবং অমূল্য। টাকার বিনিময়েও আমরা তাদের ফেরত পেতে পারি না। এই হিংসাত্মক আক্রমণ আমাদের মূল্যবোধ, আদর্শ এবং পরিচয়ের জন্য একটি অশুভ হুমকি।
বৌদ্ধরা শান্তিপ্রিয়। অহিংসা হল বৌদ্ধ এবং বৌদ্ধ ধর্মের মূলমন্ত্র। তারা অহিংসা, বন্ধুত্ব, সংহতি, সহানুভূতি এবং সমবেদনায় বিশ্বাস করে। শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর এ ধরনের হামলা কেন? এটি সাধারণ মানুষ, সুশীল সমাজের একটি বড় প্রশ্ন।
ভারতীয় উপমহাদেশের বৌদ্ধরা কালের পরিক্রমায় বহুবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। ১২-১৩ শতকে তুর্কি আক্রমণ, বখতিয়ার খিলজির দ্বারা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস সহ ধ্বংসপ্রাপ্ত সোমপুরা মহাবিহার, মহাস্থানগড়, ময়নামতি এবং অন্যান্য অনেক বৌদ্ধ বিহার এবং একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলি সর্বদা আমাদের হতবাক করে। এই বিধ্বংসী কার্যকলাপ আমাদের সমৃদ্ধ সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছে।
বাংলাদেশের বৌদ্ধদের একটি গৌরবময় ইতিহাস আছে, একটি সোনালী অতীত আছে। তারা এই মাটির সন্তান। তারা এই জমির একটি অপরিহার্য অংশ। পাল রাজারা প্রায় চারশো বছর এই ভূখণ্ড শাসন করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতার মহান চেতনায় দেশ শাসনের জন্য তাদের খ্যাতি ছিল। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক আমাদের সংবিধানে চারটি প্রধান আদর্শের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম। বৌদ্ধরা সবসময় ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে।
বৌদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে সমৃদ্ধ করেছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায় অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। এটা খুবই বিস্ময়কর যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও বৌদ্ধর সেদিন আক্রান্ত হয়েছিল। এই জঘন্যতম ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় এবং নীরব। তারা এই ঘৃণ্য কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের অবহেলা দেখিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে দোষারোপ করেছে। এই দোষ-খেলা কাম্য নয়। এভাবে চলতে থাকলে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে। ক্ষতিগ্রস্ত এবং সাধারণ মানুষ উভয়ই সন্দেহজনক যে তারা নৃশংস ঘটনার প্রকৃত বিচার পাবে কিনা।
রামু, উখিয়া, টেকনাফ এবং পটিয়ায় পুড়ে যাওয়া, ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিধ্বস্ত বৌদ্ধ বিহারগুলির একটি সম্পূর্ণ তালিকা এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে:
- ১. কেন্দ্রীয় সীমা বিহার, রামু, কক্সবাজার
- ২. রামু মৈত্রী বিহার, রামু, কক্সবাজার
- ৩. শ্রীকুল পুরাতন বিহার, রামু, কক্সবাজার
- ৪. সাদা চিং বিহার, শ্রীকুল, রামু, কক্সবাজার
- ৫. লাল চিং বিহার, শ্রীকুল, রামু, কক্সবাজার
- ৬. বড় কিয়াং, শ্রীকুল, রামু, কক্সবাজার
- ৭. উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বন বিহার, রামু, কক্সবাজার
- ৮. আর্যবংশ বৌদ্ধ বিহার, জাদিপাড়া, রামু, কক্সবাজার
- ৯. জেতবন বৌদ্ধ বিহার, উখিয়ার ঘোনা, রামু, কক্সবাজার
- ১০. বিমুক্তি ধ্যান কেন্দ্র, উত্তর মিঠাছড়ি, রামু, কক্সবাজার
- ১১. বিবেকরম বৌদ্ধ বিহার, উত্তর ফতেখারকুল, রামু, কক্সবাজার
- ১২. অজন্তা বৌদ্ধ বিহার, চাকমারকুল, রামু, কক্সবাজার
- ১৩. ধর্মজ্যোতি বৌদ্ধ বিহার, খরুলিয়া, রামু, কক্সবাজার
- ১৪. অপর্ণাচরণ বৌদ্ধ বিহার, শ্রীকুল, রামু, কক্সবাজার
- ১৫. দীপঙ্কর বৌদ্ধ বিহার, পশ্চিম মারিচ্য, উখিয়া, কক্সবাজার
- ১৬. উত্তর বড়বিল বৌদ্ধ বিহার, হালাদিয়া পালং, উখিয়া, কক্সবাজার
- ১৭. জাদিমুরা বৌদ্ধ বিহার, রাজা পালং, উখিয়া, কক্সবাজার
- ১৮. রেজুরকুল সদর্ম বিকাশ বৌদ্ধ বিহার, উখিয়া, কক্সবাজার
- ১৯. পশ্চিম রত্ন সুদর্শন বিহার, কোটবাজার, উখিয়া, কক্সবাজার
- ২০. বৌদ্ধ মহাশ্মশান বোধিজ্ঞান ধ্যান কেন্দ্র, উখিয়া, কক্সবাজার
- ২১. কালাচাঁদ বৈজয়ন্ত বিবেকরম বৌদ্ধ বিহার, ভালুকিয়া পালং, উখিয়া, কক্সবাজার
- ২২. হীরারদ্বীপ বৌদ্ধ বিহার, মারিচ্য পালং, রামু, কক্সবাজার
- ২৩. বেনুবন বৌদ্ধ বিহার, মারিচা পালং, উখিয়া, কক্সবাজার
- ২৪. রেজুরকুল সর্বজনীন বৌদ্ধ বিহার, রাজা পালং, উখিয়া, কক্সবাজার
- ২৫. লাখেরা অভয় বিহার, পটিয়া, চট্টগ্রাম
- ২৬. কোলাগাঁও বৌদ্ধ বিহার, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
তথ্য উৎস: সৌগত, ফেইজবুক পেইজ