বৌদ্ধদের মেডিটেশন নিয়ে রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের গবেষণা।

তিব্বতী বৌদ্ধ ভিক্ষু, পরমপূজ্য দালাই লামা গত সপ্তাহে বৌদ্ধদের ভাবনা ও থুকদাম ধ্যানের অনুশীলন সম্পর্কে চলমান গবেষণা সম্পর্কে রাশিয়ান নিউরো সায়েন্টিস্টদের সাথে এক গভীরতর অনলাইন সংলাপ করেছেন।

‘থুকডাম’ শব্দটি  তিব্বতী শব্দ ‘থুক’ অর্থ মন এবং ‘ডাম’ অর্থ সমাধি থেকে উদ্ভুত। এটি তিব্বতী বজ্রযানী বৌদ্ধদের মাঝে প্রচলিত একটি ধ্যান। এটি বারডো নামেও পরিচিত যা মৃত্যুর মধ্যবর্তী বা ক্রান্তিকালীন অবস্থার সময় অভিজাত বজ্রযানী বৌদ্ধদের মধ্যে প্রচলিত একটি উন্নত ধরণের তান্ত্রিক ধ্যান।

Tukdam
Tibetan monks of the first batch are undergoing training at the Moscow State University.

থাকডাম ধ্যানকারীর জীবনের জৈবিক লক্ষণগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও বেশ কয়েক দিন ধরে দেহ তাজা এবং অক্ষত থাকে। এই অবস্থাকে ধর্মীয় গুরুরা নিজেকে আধ্যাত্মিকতার এক অনন্য স্থরে পৌছাতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করেন।

তখন নিজের অভ্যান্তরিন লোভ, লালসা, হিংসা, মোহ ইত্যাদি থেকে মুক্ত হয়ে “স্পষ্টত আলোক” স্তরে উপনিত হন। মূলত অর্হৎ হিসেবে দাবী করে থাকনে। ২০১৮ সালে দালাই লামা থুকডামের নিউরোফিজিওলজিক্যাল প্রক্রিয়াগুলির জন্য একটি বৈজ্ঞানিক তদন্ত শুরু করেছিলেন।

গত ৫ মে রাশিয়ান বিজ্ঞানিদের সাথে সংলাপ চলাকালিন সময় দালায় লামা বলেন, “কিভাবে একজন মানুষ থুকডাম ধ্যান করার মাধ্যমে এই পর্যায়ে পৌঁছতে পারে সে ব্যপারে আমাদের আরও গবেষণা, গভীর তদন্ত ও পর্যালোচনা করা দরকার। আমাদের প্রমাণ করা দরকার এর উপাদান গুলো কিসের সাথে সম্পর্কিত। “পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় ধ্যানকারী মৃত ব্যক্তির শরীর উষ্ণ থাকে। তখন সম্ভবত শরীরে বিদ্যমান পৃথিবী, জল এবং আগুনের উপাদানগুলো তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় না।”

দালায় লামার বিখ্যাত বই ‘দ্য তিব্বতি বুক অফ লিভিং অ্যান্ড ডাইং’-এ, তিব্বতী জোগেনচেনের শিক্ষক সোগল লাকার ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে:

মৃত্যুকে বুঝতে সক্ষম একজন থুকডাম ধ্যান অনুশীলনকারী মৃত্যুর মুহূর্তে মনের স্বরূপের স্বীকৃতি মেনে চলতে থাকেন এবং মৃত্যু যখন প্রকাশিত হয় তখন সে গ্রাউন্ড লাইটোমোসিটিতে (Ground Luminosity) জাগ্রত থাকে। সে এমনকি বেশ কয়েক দিন ধরে এই অবস্থায় থাকতে পারেন।

Dalai lama
Dalai lama

অনেক থুকডাম ধ্যান অনুশীলনকারী সোজা হয়ে ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে মারা যান এবং সেই অবস্থাতেই বসে থাকেন অনেক দিন। আবার কোন কোন অনুশীলনকারী এবং মাস্টাররা “ঘুমন্ত সিংহের ভঙ্গীতে” মারা যান।

এই সময় তাদের নিখুঁত শালীনতা ছাড়াও, অন্যান্য লক্ষণ দেখতে পাওয়া যার মাধ্যমে তারা দেখায় যে তখন তারা গ্রাউন্ড লাইটোমোসিটি (Ground Luminosity) অবস্থায় বিশ্রাম নিচ্ছে: তাদের মুখে তখনও একটি উজ্জ্বল রঙ এবং আভা রয়ে যায়, নাকটি ভিতরের দিকে ডুবে যায় না, ত্বক নরম এবং নমনীয় থাকে, শরীর শক্ত হয়ে যায় না, চোখ দুটিতে নরম এবং করুণাময় চাহনি থাকে এবং হৃদযন্ত্রে তখনও  উষ্ণতা থাকে।

তখন এই মহান ব্যক্তির পরম যত্ন নেওয়া হয় যেন তার শরীরে কেউ স্পর্শ না করে। এই সময় পিন পতন নীরবতা বজায় রাখা হয় যতক্ষণ না সে এই ধ্যানের অবস্থা থেকে ফিরে আসে।

মৃত্যুবরণ করার বেশ কয়েক দিন পর গ্রাউন্ড লাইটোমোসিটি (Ground Luminosity) অবস্থা থেকে ফিরে আসলে শরীর আস্তে আস্তে মলিন হয়ে যায়।

বিজ্ঞানিদের এই আলোচনায় অংশ গ্রহণকারীদের মধ্যে ভারতের সেরা জে, মি, গ্যাডেন জাংটসে, শার্টস, ড্রেপং গোমং, লসলিং, তাশি লুনপো, জিউম এবং গ্যুটো মঠের ভিক্ষু ও গবেষকগণ ছিলেন।

এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ায় অবস্থিত ‘সেভ তিব্বত ফাউন্ডেশনের’ উপপরিচালক নাটালিয়া ইনোজজেম্সসেভা, ‘রাশিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্স’ এর অধ্যাপক এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ হিউম্যান ব্রেইন ইনস্টিটিউট এর প্রতিষ্ঠাতা শ্বেয়াটোস্লাভ মেদভেদেভ; মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি (এমএসইউ) এর নিউরো-ফিজিওলজি এবং নিউরো-কম্পিউটার ইন্টারফেস গবেষণাগারের প্রধান অধ্যাপক আলেকজান্ডার কাপলান; ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড ব্রেন স্টাডিজ (এমএসইউ)’র পরিচালক, কনস্ট্যান্টিন আনোখিন; নিউরোভিজুয়ালাইজেশন ল্যাবরেটরির গবেষক (সেন্ট পিটার্সবার্গের হিউম্যান ব্রেইন ইনস্টিটিউট) ইউলিয়া বোইটোসভা; সেরে জি ‍বুড্ডিস্ট মনিস্টারি এবং রাশিয়ান বিজ্ঞান কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক গেশে নাগাভাং নরবু; সেরে জে বুড্ডিস্ট মনিস্টারির-গবেষক লবসং ফুংসক এবং প্রকল্পের সমন্বয়কারী তেলো তুলকু রিনপোচে, কাল্মিকিয়ার শেডজিন লামা (প্রধান লামা) এবং রাশিয়া ও মঙ্গোলিয়ায় অবস্থানরত দালাই লামার সম্মানিত প্রতিনিধি এবং স্বাধীন রাষ্ট্রসভার কমনওয়েলথের সদস্যগণ।

Tukdam

এক পর্যায়ে রাশিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেসের অধ্যাপক মেদভেদেব দালাই লামা ও তাঁর শ্রোতাদের সামনে দলের গবেষণা কার্যক্রমের সংক্ষিপ্তসার উপাস্থাপন করেন।

তিনি দেখানা যে, দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বাইলাকাপ্পি এবং মুন্ডগোডে অবস্থিত তিব্বতি গবেষণাগারে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা থাকডাম ধ্যানরত ১০৪ ভিক্ষুদের নিয়ে একটি পরীক্ষা চালায়। কয়েকজন সিনিয়র ভিক্ষু পর্যবেক্ষণ করেছেন যে তারা থুকডাম ধ্যান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে কিনা। ঐ সময়কালে একজন ভিক্ষু ধর্মশালার নিকটবর্তী সিদ্ধবাড়ীর জ্যুটো বিহারে মৃত্যুবরণ করার পর ৩৭ দিন থুকডামে অবস্থান করেছিলেন।

ভিক্ষুটির মৃত্যুর পর তার দেহের বিভিন্ন পর্যায় গুলো পরীক্ষা করার জন্য একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞকে  আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে থুকডাম ধ্যানরত মৃত ব্যক্তির দেহ সাধারন মৃত মানুষের শরীর থেকে আলাদা। থুকডামধারীদের  মৃত্যুর পরও শরীরের সাধারণ প্রক্রিয়া গুলো বেশ কিছু দিন চলতে থাকে।

দালাই লামা ব্যাখ্যা করে বলেন যে, “তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে একজন থুকডাম অনুশীলনকারীর মৃত্যু কোন তড়িৎ ঘটনা নয়, মারা যাওয়ার ঘটনাটি শরীরের সাধারন ক্রিয়াকলাপ বিচ্ছিন্ন হওয়ার একটি প্রক্রিয়া। একজন থুকডান ধীরে ধীরে শরীর ত্যাগ তথা মৃত্যুকে বরণ করেন।

দালায় লামা বলেন,“যখন একজন সাধারণ মানুষ মারা যায়, তখন উপাদানগুলির সাধরনভাবেই বিলিন ঘটে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন যে জীবেরা অতীত এবং ভবিষ্যতের জীবনের মধ্য দিয়ে যায়, তাই এরও কিছুটা প্রভাব রয়েছে।”

তিনি আরো বলেন, “আমার নিজের সিনিয়র টিউটর, লিং রিনপোচে ১৩ দিন থুকডামে ছিলেন। সম্প্রতি, গ্যুটো মনিস্টারির একজন ভিক্ষু মৃত্যুর পর ৩৭ দিন ধরে ধ্যানরত আছেন। এটি একটি পর্যবেক্ষণযোগ্য বাস্তবতা, যা আমাদের ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হওয়া দরকার। ঘটনা গুলো দেখার ও পরিমাপ করার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। আমরা তন্ত্র গ্রন্থগুলিতে মৃত্যু প্রক্রিয়া অভ্যন্তরীণ বিষয়গত অভিজ্ঞতার একটি বিশদ বিবরণও খুঁজে পেতে পারি। আমি আশা করি বিজ্ঞানীরা এ সব বিবেচনায় নিতে পারেন এবং ব্যাখ্যা নিয়ে আমাদের সামনে আসতে পারেন। ”

Chokpa Tenzin
Chokpa Tenzin

গত বছরের সেপ্টেম্ব মাসে ৯০ বছর বয়সী চকপা তেনজিন তাঁর বেঙ্গালুরুর বাড়িতে মৃত্যু বরণ করেন।   তার প্রকাশ্য মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পরে শরীরে মৃত্যুর আর কোনও চিহ্নই ছিল না। তার শরীর কোমল ছিল, ত্বক উষ্ণ ছিল, যেন সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। তিব্বতীয় চিকিৎসদের মধ্যে যারা তার শরীর পরীক্ষা করছিলেন তাদের মতে, তিনি গভীর ধ্যানের পরিষ্কার আলোক পর্যায়ে ছিলেন। এক সপ্তাহ পরে তার দেহ অবশেষে পচনের লক্ষণ দেখাতে শুরু করল। এর মানে হলো তখন তিনি থুকডাম রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসছিলেন।

দালায় লামা ইঙ্গিত করে যে, থুকডম চর্চাকারীদের বৌদ্ধধর্মের তিনটি প্রধান পন্থা অনুসরণ করে আধ্যাত্মিক ধ্যান অনুশীলন করা উচিত। তিনটি পথ হল- ১। মুক্তি অর্জনের দৃঢ় সংকল্প, ২। চঞ্চল মন এবং ৩। অস্তিত্বের অভ্যন্তরীণ শূন্যতার বোঝাপড়া। তাদের আরো উচিত একটি উত্তম ধ্যান অনুশীলন গড়ে তোলা এবং  উপরের তিনটি দর্শনে পারদর্শী হওয়া।

শেয়ার করে সবাইকে পড়ার সুযোগ দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!