বৌদ্ধ সাহিত্যে চিকিৎস ব্যবস্থাঃ ভ্রূণতত্ত্ব

সংযুক্ত নিকায়ের যক্ষসংযুক্তে উল্লেখ আছে যে, এক সময়ে ভগবান রাজগৃহে ইন্দ্রকূট পর্বতে অবস্থান করতে ছিলেন। তখন যক্ষ ইন্দ্রক ভগবানের নিকট উপস্থিত হয়ে একটি গাথার প্রশ্ন করেছিলেন যে-

“বুদ্ধগণ রূপ ও ভৌতিক দেহকে জীব বলে বলেন না। এই সত্ত্ব কিভাবে এই শরীর লাভ করে? কোথা হতে তার অস্থি, যকৃৎ, পিত্ত, ইত্যাদি আসে? এই সত্ত্ব কিভাবে মাতৃ গর্ভে লগ্ন হয়?”

বুদ্ধ বল্লেন- “প্রথমে কলল বলে কথিত পদার্থ হয়। কলল থেকে অবুদ বলে কথিত পদার্থ হয়। এই অবুদ হতে পেশী জন্মে। পেশী থেকে ঘণ বলে মাংস পিন্ড উৎপন্ন হয়। ঘণ হতে প্রশাখা বা হস্ত পদাদি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এবং কেশ নখ লোম উৎপন্ন হয়। সত্ত্বের মাতা অন্নপান ভোজন যাহা কিছু গ্রহণ করে, মাতৃগর্ভস্থ সত্ত্ব তাতে তথায় জীবন যাপন করে।”

এখানে আমাদের জেনে রাখা উচিত সে সত্ত্বের মাতৃগর্ভে প্রবেশের জন্য তিন বিষয়ের প্রয়োজন। যথা- (১) মাতাকে ঋতুমতী হতে হবে, (২) পিতামাতার সংযোগ হতে হবে ও (৩) গান্ধবের উপস্থিতি থাকতে হবে। তাতেই কললের সৃষ্টি হবে।

উপরিউক্ত বিষয় সংযুক্ত নিকায় গ্রন্থ ছাড়া বৌদ্ধ সাহিত্যের নির্দেশ, বিশুদ্ধমার্গ এবং সংযুক্ত নিকায়ের অট্‌ঠকথায় ভ্রূণতত্ত্ব সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা আছে।

বৌদ্ধ বার্তা
সংগৃহীত নমুনা ছবি

এখানে সংযুক্ত- নিকায়ের অর্থ কথায় বর্ণিত ভ্রূণতত্ত্বের প্রত্যেক স্তরের সময় আলোকপাত করা হচ্ছে। পিতার শুক্রাণু ও মাতা ডিম্বকোষের সংযোগের ফলে গাব উপস্থিত হলে অনাবিল তিল, তৈলের আকারে কলল’- এর সৃষ্টি হয়। এই কলল মাতৃগর্ভে এক সপ্তাহ অবস্থান করে। দ্বিতীয় সপ্তাহে পরিপক্ক হয়ে মৎস্য ধৌত জলের আকারে অর্বুদে পরিণত হয়। এখানে কায়বিজ্ঞান নামক পুস্তক হতে একগাথার উদ্ধৃতি দিচ্ছি-

কায়বিজ্ঞান-দুঃখ নির্দেশ।

৮। লাতিত্বা হেতু সামগি্গ মব্বুদা দিমত্ত মাযতি,

অবিজ্জুমানে হেুতুমিহ তত্থ তত্থেব নস্সতি।

বঙ্গানুবাদঃ কর্মক্লেশাদি হেতুর উপকারিতায় অর্বুদ আকারে পরিণত হয় বটে, কিন্তু সেই সময় হেতু বিদ্যামান না থাকলে কলল অর্বুদাদি অবস্থাতেই বিনষ্ট হয়ে থাকে।

অবুদ অবস্থান এক সপ্তাহ অতিক্রম করে উহা তরল সীসার ন্যায় ঈষৎ ঘনীভূত হয়ে পেশীতে পরিণত। পেণী দেখতে এক টুকরা কাপড়ে আবদ্ধ মরিচের ঝোলের ন্যায় ঈষৎ রক্তবর্ণ। পেশ চতুর্থ সপ্তাহে গাঢ় রক্তবর্ণ কুক্কটের ডিম্বের আকারে ধারণ করে সে অবস্থার প্রাপ্ত হয় উহাকে ঘণ বলে।

কোন কোন গ্রন্থে ঘণ হতে ‘পসাখ’ অবস্থার উল্লেখ আছে। সংযুক্ত নিকায় অর্থকথায় ও কায়বিজ্ঞান গ্রন্থে ঘণ হতে হস্তপদ চতুষ্টয় ও মস্তক এই পঞ্চ অঙ্গ উৎপত্তির জন্য বর্ধিতাকারে মাংস বের হয়ে পাঁচ পীড়ক (পিলকা) উৎপন্ন হয় বলে উল্লেখ আছে।

সংযুক্ত নিকায় অর্থ কথায় আরও উল্লেখ আছে যে সত্ত্ব মাতৃগর্ভে ১৫৪ দিন অতিক্রম করে পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রাপ্ত হয়। মাতৃগর্ভে সত্ত্বের নাভি হতে উৎপল ডাঁটার ন্যায় ছিদ্রযুক্ত নাড়ী মাতার উদর (জরায়ু) পটলের সাথে একবদ্ধ হয়ে থাকে। তার মাতা যে অন্নপানাদি পানভোজন করে, সে উক্ত ভূক্ত দ্রব্যের রস মাতার উদর সম্বন্ধ যুক্ত নাড়ী দিয়ে আহরণ করে কুক্ষিগত সত্ত্ব বহুকাল জীবিত থাকে। সেই গর্ভস্থ সন্তান কর্মজ বায়ু দ্বারা স্থিত স্থান হতে পরিবর্তিত হয়ে প্রপাতরূপ যোনিমার্গে উৰ্দ্ধপাদ ও অধোশির হয়ে পতিত হয়ে থাকে। কর্মজ বায়ুর দ্বারা গর্ভজ সন্তান যোনিমার্গে উপরিউক্ত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়ে থাকে।

মাতৃগর্ভে অবস্থান কালে প্রসাদ ইন্দ্রিয় ও ভাবেন্দ্রিয় পরিপূর্ণ হয়ে স্ত্রী পুরুষ লক্ষণ পরিস্ফুষ্ট হয়। কারণ ভাব, লিঙ্গ, নিমিত্ত, কৃত্য ও আচরণ প্রভৃতি দ্বারা স্ত্রী পুরুষের পার্থক্য নির্ধারিত হয়। তখন শরীরের দীর্ঘকালের জীর্ণ অসার বৃক্ষে বহু ছিদ্র হওয়ার ন্যায় সতত দৈহিক অশুচি প্রবাহিত হবার জন্য নয় দরজা উৎপন্ন হয়।

বৌদ্ধ সাহিত্যে কর্মস্থান নির্দেশে সত্ত্বের মৃত্যুর পর মৃত দেহের দশ প্রকার অশুভ পরিবর্তনের কথা উল্লেখ আছেঃ (১) উদ্ধমাতকং- ফুলে যাওয়া, (২) বিনীলকং- মাংস বহুলস্থানে শ্বেতবর্ণ এবং শরীরের অন্যান্য স্থানে নীলবর্ণ, (৩) বিপুববকং- নয়দ্বার দিয়ে পূজ ও রস বের হয়ে দুর্গন্ধযুক্ত হওয়া, (৪) বিচ্ছিদং- মৃতদেহ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যাওয়া, (৫) বিক্খাযিতকং- মৃতদেহ ক্ষতবিক্ষত হওয়া, (৬) বিকখিত্তকং- নানা দিকে দেহের মাংস বিক্ষিপ্ত হওয়া, (৭) হতবিকখিত্তকং- ছিন্নি-বিচ্ছিন্ন মৃতদেহ। (৮) লোহিতকং- রক্ত দ্বারা স্রাবিত মৃতদেহ (৯) পুলবকং- পোকা দ্বারা পরিক্ষিপ্ত মৃহদেহ (১০) অটঠিকং- কংকার সার মৃতদেহ।

সূত্রঃ বৌদ্ধ সাহিত্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা
লেখকঃ সিতাংশু বিকাশ বড়ুয়া, এম. বি. বি. এস; এফ. সি. পি. এস

আরো পড়ুন>>

শেয়ার করে সবাইকে পড়ার সুযোগ দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!