বৈশাখী পূর্ণিমা তথা বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধদের অত্যান্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। এই দিন গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ, আলোকপ্রাপ্তি ও মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে দিনটি জাতিসংঘ দ্বারা বিশ্ব ভেসাক ডে হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন বৌদ্ধ দেশ ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে দিনটি পালন করে। আজ আমরা কোন দেশে কিভাবে বৈশাখী পূর্ণিমা পালন করে সে বিষয়ে জানাবে।
বাংলাদেশের বুদ্ধ পূর্ণিমা
যে অঞ্চলটি আজ বাংলাদেশ নামে পরিচিত, ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইসলাম ধর্মের আগমনের আগে এটি বৌদ্ধ দেশ ছিল, তাই বেশিরভাগ বাংলাদেশী মুসলমানদের মধ্যে হিন্দু বংশের পরিবর্তে বৌদ্ধ বংশধর বেশি।
বর্তমানে বাংলাদেশে বৌদ্ধ জনসংখ্যা এতই কম যে তা অত্যান্ত নগন্য। উইকিপডিয়া তথ্যমতে সব মিলিয়ে ৮,৯৮,৬৩৫ জন মত বৌদ্ধ বর্তমানে বাংলাদেশে বাস করে যা মোট জনসংখ্যার ০.৬%। সে হিসেবে বৌদ্ধধর্ম বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম।
বাংলাদেশে এই অনুষ্ঠানের নাম বৌদ্ধ পূর্ণিমা। পূর্ণিমার আগের দিন বৌদ্ধ ভিক্ষুগন বৌদ্ধ মন্দিরগুলো বর্ণিল সজ্জায়, মোমবাতি দিয়ে সজ্জিত করেন। উপাসক-উপাসিকারা বিহারে যায়, সমবেত বন্দনা করে, প্রদীপ পূজা,, ধূপ পূজা করে। কোথাও কোথাও ফানুস উড়াতে দেখা যায়।
পূর্ণিমার দিন, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস, গুরুত্ব এবং দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। দুপুরের পর থেকে মন্দির এবং বিহারগুলির আশেপাশে বড় বড় মেলা বসে, বাঙালি খাবার (মূলত নিরামিষ), জামাকাপড় এবং খেলনা বিক্রি করে। সবচেয়ে বড় মেলাটি বসে চট্টগ্রামের বৈদ্যপাড়া গ্রামে, যা বোধিদ্রুম মেলা নামে সমধিক পরিচিত।
কম্বোডিয়া
বিশ্বের সংখ্যা গরিষ্ট বৌদ্ধ দেশ গুলোর মধ্যে কম্বোডিয়া প্রথম বৃহত্তর। উইকিপডিয়ার তথ্য মতে কম্বোডিয়ার ৯৮.২% মানুষ বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। তার মধ্যে ৮৬.১% থেরবাদী বৌদ্ধ, বাকি ৪.১% মহাযানী ও বজ্রযানী বৌদ্ধ। ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যা ১৫,৪৫৮,৩৩২ জন। কম্বোডিয়ায় বুদ্ধের জন্মদিনকে ভিসাক বোচিয়া নামে পালন করা হয়। কম্বোডিয়ায় দিনটি সরকারী ছুটির দিন।
এই দিন বুদ্ধ পূর্ণিমার স্বীকৃতি স্বারূপ সারা দেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ধর্মীয় পতাকা, পদ্ম ফুল, ধূপ এবং মোমাবতি হাতে শুভাযাত্রা করে। ধর্মপ্রাণ জনসাধারন ভিক্ষুদের পিন্ডদানের ব্যবস্থা করে।
চীন
বর্তমান চীনের ৪০-৬০% লোক কোন ধর্মের অনুসারী নন। এখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৮% মানুষ বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। ১৪-১৫% মানুষ কট্টর নাস্তিক। বাকিরা স্থানীয় বিভিন্ন ধর্ম পালন করে।
বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন চীনা বৌদ্ধরা দল বেঁধে মন্দিরে যায়। যেখানে তারা প্রার্থনা করে, শীল গ্রহণ করে, ধূপ ও বাতি জ্বালিয়ে বুদ্ধকে পূজা করে।
হংকংয়ে বুদ্ধের জন্মদিন সরকারি ছুটি। বুদ্ধের জ্ঞানার্জনের প্রতীক হিসাবে লণ্ঠন জ্বালানো হয় এবং অনেক লোক বুদ্ধকে শ্রদ্ধা জানাতে বিহারে যান। বুদ্ধের মূর্তি স্নান করানো বুদ্ধের জন্মদিন উদযাপনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। ম্যাকাউতেও এই দিন সরাকারি ছুটি।
ভারত
একসময় পুরো ভারত বর্ষ বৌদ্ধরা শাসন করলেও বর্তমানে ভারতে বৌদ্ধদের সংখ্যা মাত্র ০.৮% (উইকিপিডিয়া)। বি.আর আম্বেদকর আইন ও বিচারমন্ত্রী থাকাকালীন ভারতে বৌদ্ধ পূর্ণিমা সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালন সূচনা করেছিলেন।
ভারতের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি মূলত সিকিম, লাদাখ, অরুণাচল প্রদেশ, বুদ্ধগয়া, লাহৌল স্পিতি, কিন্নৌড়, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অংশ যেমন কালিম্পং, দার্জিলিং, এবং কুরসিয়ং এবং মহারাষ্ট্রে বাস করে। যেখানে মোট ভারতীয় বৌদ্ধদের ৭৭% বাস করে মহারাষ্ট্রে। বৌদ্ধরা ছাড়াও বর্তমানে ভারতে বুদ্ধকে অনেক হিন্দু অবতার হিসেবে মানে এবং বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন বুদ্ধকে স্মরণ করে।
এই দিন বৌদ্ধরা দলে দলে বিহারে যায়, অধিকাংশ মানুষ এই দিন সাদা পোষাক পরিধান করে, ভিক্ষুরা দীর্ঘক্ষণ সূত্র আবৃত্তি করে। সুজাতার পায়সন্ন দানকে স্মরণ করতে এই দিন বিশেষ পায়সন্ন রান্না করা হয়।
ভারতে নির্বাসিত তিব্বতিরা তিব্বত বর্ষপঞ্জীর চতুর্থ মাসের ১৫ তম দিনে পবিত্র ভাসাক দিবস সাগা দাওয়া উদযাপন করে। পবিত্র মাস বৈশাখের প্রথম দিন থেকে সাগা দাওয়া শুরু হয় যা বুদ্ধের জীবনের তিনটি পবিত্র ঘটনাকে কেন্দ্র করে উদযাপন করা হয়। মাসের ১৫ তম দিনে পবিত্র বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে চলমান উৎসব শেষ হয়।
সাগা দাওয়া উপলক্ষ্যে বৈশাখ মাস জুড়ে পবিত্র, পুণ্যময় ও নৈতিক ক্রিয়াকলাপগুলি প্রতিটি বাড়িঘর, মন্দির, মঠ এবং সর্বজনীন স্থানে প্রবাহিত হয়। ভক্ত এবং অনুগামীরা এই পবিত্র মাসে অর্ধ নিরামিষ বা মাংসহীন খাবার গ্রহণ করে।
ইন্দোনেশিয়া
২০১০ সালের জাতীয় আদমশুমারি অনুসারে ইন্দোনেশিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.৮% লোক বৌদ্ধধর্ম পালন করেন। বেশিরভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জাকার্তা, রিয়াউ, রিয়াউ দ্বীপপুঞ্জ, ব্যাঙ্ককা বেলিটং, উত্তর সুমাত্রা এবং পশ্চিম কালিমান্তনে বাস করে।
ইন্দোনেশিয়ায় বুদ্ধের জন্মদিনটি ওয়েইসাক নামে পালন করা হয়। এই দিন সরকারী ছুটি। জাভার মেনডুটে থেকে এক বিশাল শোভাযাত্রা বের করার মাধ্যমে দিনটি শুরু হয়। শোভাযাত্রাটি বিশ্বের বৃহত্তম বৌদ্ধ মন্দির বোরোবুদুরে এসে শেষ হয়। এই দিন দেশটির বৌদ্ধরা বিহারে যায় শীল গ্রহণ ও বিশ্ব শান্তির জন্য প্রার্থনা করেন।
জাপান
জাপান প্রায় ৮৪ মিলিয়ন বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর বাসভূমি। এই দিন জাপানের ঐতিয্য অনুযায়ী বিহারের চারপাশ ফুল দিয়ে সাজানো হয় বিশেষ করে পদ্মফুল দিয়ে। কারন সিদ্ধার্থ গৌতম জন্মের পরপর সাত কদমে ৭টি পদ্মফুল প্রস্ফুটিত হয়েছিল বলে প্রচলিত আছে। সকালে বুদ্ধ মুর্তি স্নান করা পর বুদ্ধের শরীরে আমা-চা ছিটানো হয়। আমা-চা হলো বিভিন্ন ধরণের হাইড্রেঞ্জা পাতার সংমিশ্রনে তৈরী মিষ্টি চা। পরে বুদ্ধমুর্তির গলায় পদ্মফুলের মালা পরি সাজানো হয়।
জাপানে এই দিনের প্রধান উৎসবটির নাম হল কানবুটু-ই বা হানা-মাতসুরি (ফুলের উৎসব)। জাপানের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠির একটি অংশ আনুষ্ঠানটি এপ্রিল মাসেই পালন করে থাকে কারন তখন জাপানের বিখ্যাত চেরি ফুল ফোটে। তারা চায় চেরি ফুল দিয়ে যাতে বুদ্ধকে শ্রদ্ধা জানানো যায়। তবে অধিকাংশ বৌদ্ধ সনাতনী বৌদ্ধ পঞ্জিকা অনুসারে পালন করে থাকে।
মালয়েশিয়া
মালেয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার ৬১.৫ শতাংশ মুসলিম, ১৯.৬ শতাংশ বৌদ্ধ, ৯.২ শতাংশ খৃষ্টান এবং ৬.৩ শতাংশ জনগন হিন্দু ধর্ম পালন করে। সে হিসেবে বৌদ্ধধর্ম মালেশিয়ার ২য় বৃহত্তম ধর্ম।
মালয়েশিয়ায় বুদ্ধের জন্মদিন ওয়েসক দিবস হিসাবে পালন করা হয়। এই দিন সরকারী ছুটির দিন।
এই দিন সারা দেশে বৌদ্ধ বিহার গুলি সাজানো এবং খাঁচায় বন্দি অনেক প্রাণী মুক্ত করা হয়। সারা দেশে প্রার্থনা, সূত্রাবৃত্তি ও বিশ্বশান্তি কামনায় বিশেষ সভার আয়োজন করা হয়। এই দিন পিন্ডদানের ব্যবস্থা করা হয় এবং ভিক্ষুদের পিন্ড দান দেওয়া হয়।
মঙ্গোলিয়া
দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশ মঙ্গোলিয়া। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫.১০% মানুষ বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাস করে। মঙ্গোলিয়ায় বুদ্ধের জন্মদিনটি ইখ দুইচেন নামে পালন করা হয়। তারিখটি মঙ্গোলিয় চন্দ্র ক্যালেন্ডার দ্বারা নির্ধারিত হয়।
২০১৯ সালে মঙ্গোলিয় সংসদ দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে বিল পাশ করার মাধ্যমে অনুমোদন দিয়েছে। বিলে বলা হয়েছে দিনটি বৌদ্ধ দিবস বা গৌতম বুদ্ধের জন্ম, জ্ঞানার্জন এবং মৃত্যু দিবস হিসেবে সরকারি ভাবে পালন করার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হল।
এই দিনে বিশেষ প্রার্থনা, প্রবন্ধ রচনা প্রতিযোগীতা এবং চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
মঙ্গোলিয়ায় প্রায় ২০০ বৌদ্ধ মন্দির এবং প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ মঙ্গোলিয়ান বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নিয়ে একটি ভিক্ষু সংঘ আছে।
মায়ানমার
মিয়ানমারে বুদ্ধের জন্মদিন কেসন পূর্ণিমা নামে উদযাপিত হয়। মিয়ানমারে দিনটি সরকারী ছুটি দিন। এটি মিনয়ামনারের সবচেয়ে গরমতম দিনে পড়ে। তাই এই দিন তারা বোধি বৃক্ষে জল ঢালা, ফুল দিয়ে সজ্জিত করা, সূত্র পাঠ, আলোক প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে দিনটি পালন করে। বড় বড় পাগোডাডা গুলোতে ধর্মীয় সংগীত অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে।
নেপাল
নেপাল বুদ্ধের জন্মস্থান। বর্তমান নেপালের লুম্বিনি নামক স্থানে বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। মে মাসে যে পূর্ণিমা হয় সেটি বুদ্ধপূর্ণিমা হিসেবে পালন করা হয়। নেপালে দিনটি বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন- বুদ্ধ জয়ন্তী, বুদ্ধ পূর্ণিমা, বৈশাখী পূর্ণিমা, সাগা দাওয়া এবং ভেসাক।
পূর্ণিমা অর্থ সংস্কৃতে পূর্ণ চন্দ্র দিবস। নেপালের নেওয়ার বংশীয়দের মধ্যে, বিশেষত নেওয়ার্স গোত্রের শাক্য বংশের কাছে দিনটির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কারণ সিদ্ধার্থ গৌতম নেপালের শাক্যবংশে জন্মগ্রহণ করে পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করেছিল। তারা দিনটি ফুলের পূর্ণিমা বা তাদের ভাষায় Swānyā Punhi (स्वांया पुन्हि) নামে উদযাপন করে।
নেপালিরা এই দিন বিহারে যান। অন্য দশ দিনের চেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রার্থনা করে। এই দিন বেশির ভাগ নেপালি সাদা পোশাক পরিধান করে, আমিষ জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলে। সুজাতার পায়সন্ন দানকে স্মরণ করে খির, মিষ্টি, পায়সন্ন রান্না করে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে।
উত্তর কোরিয়া
বুদ্ধের জন্মদিনটি সাধারনত উত্তর কোরিয়ায় একটি সরকারী ছুটির দিন। উত্তর কোরিয়ায় দিনটি চপাইল (초파일) নামে পরিচিত।
বুদ্ধের জন্মদিন কোরিয়ান সংস্কৃতিতে একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। দিনটি পালন করার আয়োজন বেশ কয়েক দিন আগে থেকে শুরু হয়। দুই কোরিয়া ভাগ না হওয়ার অনেক আগে থেকে দিনটি মর্যদার সাথে পালিত হয়ে আসছে। এখনো উত্তর কোরিয়ার বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মাঝে সবচেয়ে মর্যদার দিন এটি।
দক্ষিণ কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ায় বুদ্ধের জন্মদিনটি কোরিয়ান চন্দ্র ক্যালেন্ডার অনুসারে পালিত হয় এবং এটি একটি জাতীয় ছুটি। এই দিনটিকে বুচোনিম ওসিন নাল (부처님 오신 날) নামে পরিচিত করা হয়। বুচোনিম ওসিন নাল (부처님 오신 날) এর অর্থ “যে দিন বুদ্ধ এসেছিলেন।”
সারা দেশের প্রতিটি বিহার, ঘর, রাস্তায় এক মাস ধরে পদ্ম ফানুস নামে এক ধরনের লন্ঠন ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই দিন প্রতিটি বিহারে আগত সমস্ত দর্শনার্থীদের জন্য বিনামূল্যে খাবার এবং চা সরবরাহ করা হয়।
সন্ধ্যায় ইয়েন্ডিঙ্গোয়ে নামে একটি বিশাল ফানুস উৎসবের আয়োজন করা হয়। সবাকে সকালের নাস্তা এবং দুপুরের সরবরাহ করা হয়। যার মধ্যে প্রায়শই স্যাঞ্চে বিবিম্বপ (একধরনের কোরিয় দামী খাবার) অন্তর্ভুক্ত থাকে। বুদ্ধের জন্মদিন কোরিয়ার একটি জনপ্রিয় উৎসব ও সরকারি ছুটি হিসেবে সকল ধর্মের মানুষ এটি পালন করে।
সিঙ্গাপুর
সিঙ্গাপুরে, বুদ্ধের জন্মদিন ভেসাক বা ভেসাক দিবস হিসাবে পালন করা হয়। সকালে বুদ্ধমুর্তি স্নান করার মাধ্যমে দিনটি শুরু হয়।
এই দিন সকলে ফুল, মোমবাতি এবং সিদ্ধি লাটি (joss sticks) ইত্যাদি নিয়ে বিহারে যায়। সারা দিন মোমবাতি এবং জাসের লাঠিগুলি জ্বলে। এক সময় ফুলগুলি শুকিয়ে যাওয়া দেখিয়ে সমস্ত উপাসকদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে জীবন ফুলের মতো ক্ষণস্থায়ী। সুন্দর ফুল যেমন সকাল থেকে বিকাল হতে হতে মলিন হয়ে যায় তেমনি সব কিছু ক্ষয় হয়ে শেষ হয়ে যাবে।
শ্রীলংকা
শ্রীলঙ্কায়, বুদ্ধের জন্মদিন ভেসাক হিসাবে উদযাপিত হয়। অন্যান্য বৌদ্ধ দেশের মতো এটি মে মাসের প্রথম পূর্ণ চাঁদের দিন পালিত হয়। এর তারিখ বৌদ্ধ চন্দ্র ক্যালেন্ডার দ্বারা নির্ধারিত হয়।
লোকজন উৎসবটি পালন করার জন্য মোমবাতি এবং কাগজের ফানুস তৈরী করে। রাস্তাঘাট বাঁশের ফ্রেম যুক্ত কাগজের ফানুস ঝুলিয়ে সজ্জিত করা হয়।
ডানসালাস নামক একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিহারে আগত লোকেদের বিনামূল্যে খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা করা হয়। দিনের বিভিন্ন সময় শ্রীলংকায় প্রচলিত জনপ্রিয় ভক্তি মূলক গান বকথি গী গাওয়া হয়।
থাইল্যান্ড
থাইল্যান্ডে বুদ্ধের জন্মদিনটি বৈশাখ বোচা দিবস নামে উদযাপিত হয়। যথারীতি এটি একটি সরকারী ছুটির দিন। থাই ঐতিহ্য অনুসারে এই দিন বৌদ্ধরা বিহারে যান বিশেষ করে ‘ওয়াট ফেরা কাইও’ যেখানে পান্না বুদ্ধের মুর্তি আছে এবং সানাম লুয়াং থাকনে। এই দিন বুদ্ধের মূর্তিগুলিতে সোনার পাতার আঁটি লাগানো হয়।
এই পবিত্র দিনে থাই দোকান, বার এবং রেস্তোঁরাগুলিতে অ্যালকোহল বা মদ বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়। সমস্ত সরকারী অফিস এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এই দিন বন্ধ থাকে। দিবসটি উপলক্ষে সমস্ত স্কুল এবং কলেজগুলিতে বৌদ্ধ ধর্মীয় পতাকা ঝুলিয়ে রাখে।
ভিয়েতনাম
ভিয়েতনামের ১৬% মানুষ বৌদ্ধ ধর্ম পালন ও অনুশীন করেন। বুদ্ধের জন্মদিন সমগ্র ভিয়েতনাম জুড়ে উদযাপিত হয়। ভিয়েতনামে বৌদ্ধ পূর্ণিমাকে লু ফাটন নামে পালন করা হয়।
এই দিন সারা দেশের প্যাগোডা গুলো চোখে লাগার মতো সাজানো হয়। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল বুদ্ধের জন্মদিনটি দক্ষিণ ভিয়েতনামে জাতীয় ছুটি হিসাবে স্বীকৃত ছিল। বুদ্ধের জন্মদিন ভিয়েতনামে এখনও একটি জনপ্রিয় ও পবিত্র উৎসব, তবে বর্তমান ভিয়েতনামে দিনটি সরকারী ছুটি নয়।
এশিয়ার বাইরে উৎসব
অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ার ২.৭০% মানুষ বৌদ্ধ। প্রধানত সিডনির ওলংগং এ অবস্থিত বৌদ্ধ বিহার নান টিয়েন মন্দিরে বুদ্ধের জন্মদিন উদযাপন করা হয়। অন্যদিকে ডার্লিং হারবারে অবস্থিত নান টিয়েন মন্দির দ্বারা পরিচালিত আরো কয়েকটি বৌদ্ধ বিহারে দিনটি পালন করা
এখানকার মানুষ চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া সহ নানা দেশের সংস্কৃতি সংমিশ্রনে দিনটি উদযাপন করে। দিনটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরণের নিরামিষ খাবার পরিবেশন করা হয়।
অস্ট্রেলিয়ার ফো গুয়াং শানে ‘নান টিয়ান টেম্পল’ গ্রুপ দ্বারা পরিচালিত অন্যান্য মন্দিরগুলিও চীন চন্দ্র ক্যালেন্ডার অনুসারে দিনটি পালন করে।
ব্রিসবনে, বুদ্ধের জন্মদিন প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে বিভিন্ন ধরণের এশিয়ান খাবার প্রদর্শিত হয়। এটি সপ্তাহ ব্যাপী চলা সবচেয়ে দীর্ঘ উৎসব গুলোর মধ্যে একটি যেখানে প্রায় ২০০,০০০ এরও বেশি দর্শনার্থী উপস্থিত থাকে।
মেলবোর্নের ফেডারেশন স্কোয়ারে দিনটি বুদ্ধ দিবস এবং বহু সংস্কৃতির উৎসব নামে সপ্তাহ ব্যাপি চলতে থাকে। পার্থের ল্যাংলি পার্কে বুদ্ধ দিবস ও বহুসংস্কৃতি উৎসব নামে পরিচিত একটি দুই দিনের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় বৌদ্ধ মন্দির সহ বেনডিগো, ভিক্টোরিয়ার মতো ছোট ছোট শহরগুলিতেও এই অনুষ্ঠান পালিত হয়।
অস্ট্রেলিয়ান বাহ্যিক অঞ্চল ক্রিসমাস দ্বীপেও বুদ্ধের জন্মদিনটি “ভেসাক ডে” হিসাবে উদযাপিত হয়।
ব্রাজিল
ব্রাজিলে অবস্থানরত বিশাল জাপানি সম্প্রদায়ের কারণে ভেসাক (হন-মাতসুরি) ব্যাপক পরিচিত এবং উদযাপিত হয়। হন-মাতসুরি জনপ্রিয়তার সাথে বেড়ই চলেছে। জাপানীজদের পাশাপাশি স্থানীয় ব্রাজিলীয়দের আকর্ষণ করছে দিনটি। ফলস্বরূপ, হন-মাতসুরি দেশের অন্যতম প্রধান সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। কখনও কখনও স্থানীয়ভাবে দিনটি ‘ফেস্টা দাস ফ্লোরস’ নামেও পরিচিত হয়।
বিশেষ করে হানামাতসুরি অনুষ্ঠানটি লিবারডাডের সাও-পাওলোতে উদযাপিত হয় যেখানে জাপানের বাইরে সবচেয়ে বেশি জাপানি বাস করে। ১৯৬৬ সালে সর্ব প্রথম লাইবারডাডে এক বিশাল কুঁচকাওয়াজের মাধ্যমে হনামাতসুরি উদযাপন শুরু হয়েছিল।
কানাডা
টরন্টোতে বসবাসরত বৌদ্ধধর্মের তিনটি প্রধান শাখার প্রতিনিধিত্বকারী তিনটি বৌদ্ধ মন্দির দিনটি এক যোগে পালন করে। প্রধান অনুষ্ঠানটি মিসিসাগা উদযাপন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত হয়। এতে বৌদ্ধ ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ যেমন, প্রার্থনা, সূত্রপাঠ, আলোকপ্রজ্জ্বলন ইত্যাদি করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র
জাতিসত্তা ও জাতীয়তার উপর নির্ভর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বুদ্ধের জন্মদিন উদযাপন সম্প্রদায় ভিত্তিতে আলাদা হয়ে থাকে।
৮ই এপ্রিল জাপানি উদযাপন হান-মাতসুরি কয়েক দশক ধরে ক্যালিফোর্নিয়ার উপসাগরীয় অঞ্চলে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে পালিত হয়ে আসছে। ১৮৬৮ সালে মাউন্ট টলাপাইসে সর্ব প্রথম বুদ্ধের জন্মদিন পালন করা হয়। পরবর্তিতে ১৯৬৯ সাল থেকে প্রতি বসন্তে তাসাজারা জেন মাউন্টেন সেন্টার থেকে বুদ্ধের জন্মদিন উপলক্ষ্যে হানা-মাতসুরি উদযাপন শুরু হয়।
নিউ ইয়র্কের আন্তর্জাতিক লোটাস ল্যানটেন প্যারেড ইউনিয়ন স্কয়ার পার্কে প্রতিবছর বুদ্ধপূর্ণিমার দিন একটি বিশেষ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটি (ইওন দেউং হো (연등회, 燃燈 會) আমেরিকায় বসবাসরত কোরিয় জনগনের দ্বারা আয়োজিত হয়।
১৯৬৩ সাল থেকে হাওয়াই রাজ্য প্রতিবছর ৮ই এপ্রিলকে “বুদ্ধ দিবস” হিসাবে পালন করার স্বীকৃতি দিয়েছে।
- বৈশাখী পূর্ণিমাঃ ১ম পর্বে
- বৈশাখী পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে জাতিসংঘ মহা সচিবের বার্তা।
- একজন প্রাক্তন আইন প্রণেতা ও বুদ্ধের শিক্ষা
- কোন দেশে কত বৌদ্ধ বাস করেন।