ভান্তে নাগসেন ও রাজা মিলিন্দের প্রশ্নোত্তর পর্বের এক পর্যায়ে রাজা মিলিন্দ ভাগসেন ভান্তেকে প্রশ্ন করেন, “সকল জীব কি মৃত্যুকে ভয় করে? অর্হৎগণ কি মৃত্যুকে ভয় করেন, নরকাগ্নিতে জ্বলিত, সিদ্ধ, তপ্ত সন্তপ্ত অবস্থায় সেই মহা নরক হইতে মরিয়া মুক্তির সময় মৃত্যুকে ভয় করে কি?
ভান্তে নাগসেন যুক্তি, উপমা, উদাহরণ দিয়ে রাজা মিলিন্দকে খুশি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ভান্তে নাগসেন ও রাজা মিলিন্দের প্রশ্নোত্তর পড়ুন নিচে-
“ভন্তে নাগসেন! ভগবান ইহাও বলিয়াছেন, ‘সকলেই দণ্ড হইতে শঙ্কিত হয়, সকলেই মৃত্যুকে ভয় করে’। পুনরায় তিনি বলিয়াছেন ‘অর্হৎ সর্ববিধ ভয় অতিক্রম করিয়াছেন’। কেমন, ভন্তে! দণ্ড অর্হতের পক্ষে ত্রাসজনক নহে কি? অথবা নরকে নারকীয় প্রাণিগণ নরকাগ্নিতে জ্বলিত, সিদ্ধ, তপ্ত ও সন্তপ্ত অবস্থায় সেই মহানরক হইতে মরিয়া মুক্তির সময় মৃত্যুকে ভয় করে কি?
ভন্তে! যদি ভগবান সত্যই বলিয়া থাকেন,‘সকলেই মৃত্যুকে ভয় করে’ তাহা হইলে এই কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয় যে‘অর্হৎ সর্ববিধ ভয় অতিক্রম করিয়াছেন’।
পক্ষান্তরে ভগবান যদি বলিয়া থাকেন যে‘অর্হৎ সর্ববিধ ভয় অতিক্রম করিয়াছেন’ তাহা হইলে একথা বলা যায় না‘—সকলেই মৃত্যুকে ভয় করে।’
ভন্তে! ইহাও উভয় কোটিক প্রশ্ন আপনার নিকট উপস্থাপিত হইয়াছে। আপনাকে ইহার নিষ্পত্তি করিতে হইবে।”
“মহারাজ! ভগবান যে বলিয়াছেন-‘সকলেই দণ্ড হইতে শঙ্কিত হয়, সকলেই মৃত্যুকে ভয় করে’ইহা অর্হৎগণকে উপলক্ষ করিয়া বলেন নাই। অর্হৎ এই নিয়মের ব্যতিক্রম। অর্হতের ভয়-হেতু সমুচ্ছিন্ন হইয়াছে।
মহারাজ! যে সকল প্রাণী কলুষমুক্ত নহে, যাহাদের অত্যধিক আত্ম-দৃষ্টি বিদ্যমান এবং যাহারা সুখে ও দুঃখে উন্নতাবনত হয়, তাহাদের উদ্দেশ্যেই ভগবান ইহা বলিয়াছেন—।
মহারাজ! অর্হতের সর্ববিধ গমনাগমন উপচ্ছিন্ন হইয়াছে। যোনি-ভ্রমণ শেষ হইয়াছে, পুনর্জন্ম রুদ্ধ হইয়াছে। জন্মের উপকরণ বিচূর্ণ হইয়াছে। সমস্ত ভবের প্রতি আসক্তি ক্ষয় হইয়াছে। সর্ব সংস্কার বিনষ্ট হইয়াছে, কুশলাকুশল কর্ম ক্ষয় হইয়াছে, অবিদ্যা সমূহত হইয়াছে। বিজ্ঞান বীজহীন হইয়াছে। সমস্ত কলুষ দগ্ধ হইয়াছে, এবং লোকধর্ম অতিক্রান্ত হইয়াছে। সেই কারণে অর্হৎ কোন প্রকার ভয়ে সন্ত্রস্ত নহেন।
মহারাজ! (মনে করুন) কোন রাজার চারিজন মহামাত্য আছে, যাহারা তাঁহার অনুরক্ত, যশস্বী, বিশ্বাসভাজন এবং উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত। সেই সময় কোন প্রয়োজন উপস্থিত হইলে রাজা যদি স্বীয় রাজ্যের সমস্ত লোকের প্রতি আদেশ করেন- ‘রাজ্যের সকলেই আমাকে রাজস্ব সন্ত্রাস উৎপন্ন হইবে কি?”
“না, ভন্তে!”
“কেন, মহারাজ?”
“ভন্তে! তাঁহারা রাজার উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত, তাঁহাদের রাজস্ব দিতে হয় না। তাঁহারা রাজস্ব হইতে অব্যাহতি পাইয়াছেন। অপর জনগণের উদ্দেশ্যে রাজা আদেশ দিয়াছেন যে‘যে সকলেই ভয়ের হেতু সমুচ্ছিন্ন হইয়াছে।
মহারাজ! যে সকল প্রাণী কলুষমুক্ত নহে, যাহাদের অত্যধিক আত্ম-দৃষ্টি বিদ্যমান এবং যাহারা সুখে কিংবা দুঃখে বিচলিত হয় তাহাদের উদ্দেশ্যে ভগবান বলিয়াছেন- ‘সকলেই দণ্ডকে আশঙ্কা করে, সকলেই মৃত্যুকে ভয় করে।’ সেই কারণে অর্হৎ কোন প্রকার ভয়ে সন্ত্রস্ত নহেন।”
“ভন্তে! কিন্তু‘সকলেই’ এই যে শব্দ বলা হইয়াছে, উহাতে কেহ বাদ পড়ে না। ইহার প্রয়োগ দ্বারা প্রত্যেকেই গৃহীত হয়। আপনার কথিত বাক্য প্রতিষ্ঠিত করিবার নিমিত্ত আমাকে আরও প্রমাণ প্রদর্শন করুন।”
“মহারাজ! কোন গ্রামের অধিপতি স্বীয় অজ্ঞাবহকে আদেশ করে-‘ওহে! যাও, এই গ্রামে যত গ্রামবাসী আছে, তাহাদের সকলকে সত্বর আমার নিকটে আনয়ন কর।’
সে‘সাধু, প্রভু!’ বলিয়া স্বীকার করিল এবং গ্রামের মধ্যে দাঁড়াইয়া তিন বার উচ্চৈস্বরে ঘোষণা করে- ‘গ্রামে যত গ্রামবাসী আছে তাহারা শীঘ্র অধিপতির নিকটে সম্মিলিত হও।’ তৎপর আজ্ঞাবহের ঘোষণানুসারে গ্রামবাসীরা শীঘ্র একত্র হইয়া গ্রামের অধিপতিকে বলে- ‘প্রভু! সমস্ত গ্রামবাসী সম্মিলিত হইয়াছে। এখন আপনার যাহা কর্তব্য তাহা করিতে পারেন।’
মহারাজ! এই প্রকারে গ্রামাধিপতি একত্রিত হইবার জন্য সকল গ্রামবাসীকে আদেশ দেন। আদেশ পাইয়া তাহারা সকলেই সম্মিলিত হয় না।, কেবল কুটিবাসীরাই সম্মিলিত হয়। তখন‘এই পরিণাম আমার গ্রামবাস’ বলিয়া গ্রামস্বামী তদ্রুপে স্বীকার করেন। অপর বহু সংখ্যক স্ত্রী-পুরুষ, দাসদাসী, ভৃত্য কর্মচারী, গ্রামবাসী রোগী, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, কুকুর প্রভৃতি থাকে, যাহারা আসে না। তাহারা গণনার পর্যায়ভুক্ত হয় না। কেননা, কেবল কুটিবাসীগণকে উপলক্ষ করিয়া আদেশ দেওয়া হইয়াছে যে‘সকল সম্মিলিত হউক।
মহারাজ! এই প্রকারই ভগবান এই বাক্য অর্হৎ-গণের উদ্দেশ্যে ভাষণ করেন নাই,—। সেই কারণে অর্হৎ কোন প্রকার ভয়ে ভীত হন না।
মহারাজ! শব্দের অর্থ চারি প্রকারে বুঝিতে হয়, যথা (১) কোন সাবশেষ বাক্য আছে তাহার অর্থও সাবশেষ বা অব্যাপক, (২) কোন বাক্য আছে সাবশেষ কিন্তু তাহার অর্থও সাবশেষ বা ব্যাপক, (৩) কোন বাক্য আছে নিরবশেষ কিন্তু তাহার অর্থ সাবশেষ, (৪) কোন বাক্য আছে নিরবশেষ আর তাহার অর্থও নিরবশেষ।
অতএব যথাযথ রূপেই বাক্যের অর্থ গ্রহণ করা উচিত। মহারাজ! পাঁচ প্রকারে অর্থ গ্রহণ করিতে হয়। যথা (১) আহরিত পদানুসারে, (২) রসানুসারে, (৩) আচার্যবংশ পরম্পরানুসারে, (৪) অভিপ্রায়ানুসারে, এবং (৫) উত্তরতর কারণানুসারে। এক্ষেত্রে আহরিত পদের অর্থ সূত্র বা বুদ্ধবাণী অভিপ্রেত হইয়াছে। রস-শব্দে সূত্রের অনুরূপ ভাব বুঝিতে হইবে। আচার্যবংশ দ্বারা আচার্য পরম্পরায় যে অর্থ স্বীকৃত হইয়াছে, তাহা গ্রহণীয় হইবে। অভিপ্রায় অর্থ নিজের যুক্তিসঙ্গত অভিমত বুঝিতে হইবে। উত্তরতর কারণানুসারে অর্থ পূর্বোক্ত চতুর্বিধ উপায়ের সহিত সামঞ্জস্য যুক্ত কারণ। মহারাজ! এই পঞ্চ কারণে অর্থ গ্রহণ করিতে হয়। এইরূপে এই প্রশ্নের সুসমাধান হয়।”
“হউক, ভন্তে নাগসেন! আমি তাহা তদ্রুপেই স্বীকার করিতেছি। অর্হৎ এই নিয়মের ব্যতিক্রম হউক। আর অবশিষ্ট প্রাণীরা ভয় প্রাপ্ত হউক। কিন্তু নরকে যে সকল প্রাণী তীব্র, কঠোর, দুঃখ-বেদনা অনুভব করে, যাহাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জ্বলিত, প্রজ্বলিত, যাহাদের মুখ করুণ, রোদন, ক্রন্দন, পরিদেবন ও অনুতাপে পরিপূর্ণ, যাহারা অসহ্য, তীব্র, দুঃখ-প্রপীড়িত, যাহাদের ত্রাণ নাই, শরণ নাই, অবলম্বন নাই, যাহারা অপরিমেয় শোক-সন্তপ্ত, যাহাদের অন্তিম চরম দশা উপস্থিত, যাহারা একান্তা শোক পরায়ণ, যাহারা উষ্ণ, তীক্ষ , প্রচণ্ড কঠোর তপনতেজে উত্তপ্ত, যাহারা ভীষণ ভয়জনক চীৎকার ও মহাশব্দ করিতেছে, এবং যাহারা বিজড়িত ষড়বিধ জ্বালায় আকুল; সেই সমস্ত জীব চতুর্দিকে শতযোজন ব্যাপী বিস্তৃত অগ্নি জ্বালায় বেগযুক্ত কদর্য তপন নামক মহানরক হইতে চ্যুত হইবার সময় মৃত্যুকে ভয় করে কি?”
“হাঁ, মহারাজ!”
“ভন্তে! নরকেও একান্ত দুঃখ ভোগ করিতে হয়, তবে কেন সেই নরকস্থ প্রাণীরা একান্ত দুঃখ ভোগের স্থান নরক হইতে চ্যুত হইবার সময় মৃত্যুকে ভয় করে? কেন, নরকে কি তাহারা রমিত হয়?”
“ভন্তে! ইহা আমি বিশ্বাস করি না যে মুক্তি অভিলাষীদের তথা হইতে চ্যুতির সময় সন্ত্রাস উৎপন্ন হইতে পারে।
ভন্তে! তাহারা যে প্রার্থিত স্থান লাভ করে তাহা ত হাস্যজনকই হইবে। আপনি আরও প্রমাণ দিয়া আমাকে বুঝাইয়া দিন।”
(ক) “মহারাজ! যাহারা চারি আর্যসত্য দর্শন করে নাই তাহাদের পক্ষে‘মরণ’ এক ভয়ের কারণ। এ বিষয়ে জন সাধারণ সন্ত্রাসযুক্ত ও উদ্বিগ্ন হয়।
মহারাজ! যে কৃষ্ণসর্পকে ভয় করে, সে মরণকে ভয় করে, বলিয়াই কৃষ্ণসর্পকে ভয় করে। আর যে ব্যক্তি হস্তী, সিংহ, ব্যাঘ্র, নেকড়ে বাঘ, ভল্লুক, হায়েনা, মহিষ, গো, অগ্নি, জল, গোঁজ, কণ্টক বা অস্ত্রকে ভয় করে, সে মৃত্যুকে ভয় করে বলিয়াই এই গুলিকে ভয় করে।
মহারাজ! মরণেরই ইহা স্বরসভাব বা স্বাভাবিক তেজ। মরণের স্বরসভাব বা স্বাভাবিক তেজ হেতু ক্লেশযুক্ত প্রাণিগণ মরণকে আশঙ্কা করে, ভয় করে। মুক্তি অভিলাষী হইলেও নরকস্থ জীবগণ মৃত্যুকে আশঙ্কা ও ভয় করিয়া থাকে।
(খ) মহারাজ! যদি কোন লোকের শরীরে পুঁজ-পূর্ণ ফোঁড়া উৎপন্ন হয়, সে এই রোগে দুঃখিত হইয়া যন্ত্রণা হইতে মুক্তির ইচ্ছায় শল্য-চিকিৎসককে আহ্বান করিল। চিকিৎসক আসিয়া তাহার রোগের অস্ত্রোপাচারের জন্য উপকরণ তৈয়ার করিবেন। অস্ত্রকে তীক্ষ করিবেন। শলাকাদ্বয় অগ্নিতপ্ত করিবেন। ক্ষার লবণ শিলপাটায় পেষণ করাইবেন। মহারাজ! তীক্ষ অস্ত্রোপাচারের দরুণ, শলাকাদ্বয়ের দাহের দরুণ এবং ক্ষার লবণ প্রবেশের দরুণ রোগীর ভয় উৎপন্ন হইবে না কি?”
“হাঁ, ভন্তে! অবশ্যই হইবে।”
“মহারাজ! এইরূপে রোগমুক্তির ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যন্ত্রণাভয়ে রোগীর যেমন সন্ত্রাস উৎপন্ন হয়, সেইরূপ নরকে পতিত জীবগণের- তথা হইতে মুক্তির অভিলাষ থাকিলেও- মরণ ভয়ে সন্ত্রাস উৎপন্ন হয়।
(গ) মহারাজ! এখানে যদি কোন রাজ-অপরাধী হাতকড়া ও শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় কারাগারে প্রক্ষিপ্ত হয়। তাহার দণ্ড মুক্তির আকুল আগ্রহ থাকে কারারক্ষী মুক্তি দিবার ইচ্ছায় তাহাকে আহ্বান করেন। তবে মহারাজ! সেই অপরাধী পুরুষের স্বীয় অপরাধ স্মরণ করিয়া রাজ-দর্শনে সন্ত্রাস উৎপন্ন হইবে কি?”
“হাঁ ভন্তে! তাহার ভয় হইবে।”
“মহারাজ! এইরূপে রাজ-অপরাধী ব্যক্তির মুক্তির আকুল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও যেমন রাজভয়ে সন্ত্রাস উৎপন্ন হয়, সেইরূপ নরকে পতিত সত্ত্বগণের তথা হইতে মুক্তির অভিলাষ থাকিলেও- মরণ ভয়ে সন্ত্রাস উৎপন্ন হয়।”
“ভন্তে! আরও উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দিন যাহাতে আমি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিতে পারি।”
(ঘ) “মহারাজ! যদি কোন ব্যক্তি বিষধর সর্পদ্বারা দংশিত হয়, সে সেই বিষবিকারে উঠা-পড়া করে, ইতস্ততঃ গড়াগড়ি দেয়, তখন কোন লোক শক্তিশালী মন্ত্রদ্বারা সেই বিষধর সর্পকে আনাইয়া দংশিত বিষ তাহারই দ্বারা পুনঃ পান করায়। যখন সেই বিষধর সর্পকে রোগীর স্বস্তির হেতু তাহার সমীপে আসে তখন বিষ-পীড়িতের সন্ত্রাস উৎপন্ন হইবে কিনা?”
“হাঁ, ভন্তে! অবশ্যই হইবে।”
“মহারাজ! এইরূপে স্বস্তির নিমিত্তও তাদৃশ সর্প নিকটে আসিলে তাহার যেমন সন্ত্রাস উৎপন্ন হয়, সেইরূপ নরকে পতিত জীবগণের তথা হইতে মুক্তির অভিলাষ থাকিলেও- মরণ ভয়ে সন্ত্রাস উৎপন্ন হয়। মহারাজ! সমস্ত প্রাণীর পক্ষে মরণ অবাঞ্ছিত। সে কারণে নরকস্থ প্রাণিগণ তথা হইতে মুক্তির জন্য ইচ্ছুক হইলেও মৃত্যুকে ভয় করিয়া থাকে।”
“সাধু, ভন্তে নাগসেন! আপনি যাহা বলিবেন, তাহা তদ্রুপেই স্বীকার করিতেছি।”
আরো পড়ুন>>
- যে প্রশ্নের উত্তর বুদ্ধ দেননি।
- ক্ষুদ্র শিক্ষাপদগুলি কি আর অনুক্ষুদ্র শিক্ষাপদগুলিই বা কী?-রাজা মিলিন্দ।
- বুদ্ধের ঋদ্ধি বল দর্শন।
- জৈন ধর্মমত ও বুদ্ধের আপত্তি।
- তথাগতগণের উত্তর করণীয়।