বৌদ্ধধর্ম ও ডা. কারজিনের অবদান

ব্যারি মাইকেল কারজিন (জন্ম ১ নভেম্বর, ১৯৪৭) একজন আমেরিকান চিকিৎসক এবং বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। তিনি ১৯৮৮ সাল থেকে ভারতের হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় বসবাস করছেন। তিনি ১৪তম দালাই লামার ব্যক্তিগত চিকিত্সক হিসাবে কাজ করার পাশাপাশি স্থানীয় সম্প্রদায়ের লোকেদের চিকিত্সা করেন৷

Barry Michael Kerzin
Barry Michael Kerzin

২০০৩ সালে জানুয়ারীতে দালাই লামা কর্তৃক তিনি সন্ন্যাস জীবন লাভ করেন। তিনি দীক্ষা নিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে। ভিক্ষুত্ত্ব জীবন লাভ করে তিনি ভ্রমণ করেছেন, শিক্ষা দিয়েছেন এবং কর্মশালা প্রদান করেছেন। তিনি বৌদ্ধ শিক্ষা এবং তার চিকিৎসা প্রশিক্ষণকে মিশ্রিত করে এক নতুন চিকিৎসা চালু করেছিলেন। মস্তিষ্কে মেডিটেশনের প্রভাব সম্পর্কে স্নায়ুবিজ্ঞানের একটি গবেষণা তিনি অংশগ্রহণকারী হিসাবে কাজ করেন।

কেরজিন হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের (HKU) একজন সহযোগী অধ্যাপক (২০২১/২২), পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহায়ক অধ্যাপক (৭/২০২০ থেকে) এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের একজন প্রাক্তন সহকারী অধ্যাপক। তিনি Altruism in Medicine Institute (AIMI) এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি এবং জাপানে হিউম্যান ভ্যালুস ইনস্টিটিউট (HVI) এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান।

প্রথম জীবন এবং শিক্ষা

কারজিন ১৯৪৭ সালে ১ নভেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট বয়সে তিনি D.T. Suzuki’s World of Zen-এর একটি বই পড়ে বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। প্রায় ছয় বছর থেকে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতেন। “তিনি কে, কেন তিনি এখানে” এমন সব প্রশ্নে জর্জরিত হয়েছিলেন তিনি। সে হাই স্কুলে পড়াকালীন সময়ে একটি দর্শন ক্লাবে যোগদান করেন এবং কলেজে দর্শন বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন।

তাঁর বয়স যখন এগারো বছর তখন তার মস্তিষ্কে একটা ফোড় হয়েছিল যার কারনে সে অনেকদিন কোমায় ছিল। পরবর্তীতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সেরে উঠলে একজন ডাক্তার হওয়ার ভাসনা তাকে পেয়ে বসেছিল। এই জন্য তিনি মনেপ্রাণে একজন ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।

কারজিন বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে বিএ এবং ১৯৭৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এমডি ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবন

Barry Michael Kerzin
Barry Michael Kerzin

কারজিন কর্মজীবনে সে তার বাসস্থান ভেনচুরা কাউন্টি মেডিকেল সেন্টারে এবং সাত বছর ওহায়, ক্যালিফোর্নিয়ার পারিবারিক ঔষধ নিয়ে অনুশীলন করেন। তার বয়স যখন মাত্র ২৭ বছর তখন তার মা মারা যান। তিনি ওহাইতে কাজ শুরু করার ঠিক পরেই তার স্ত্রীর ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং ১৯৮৩ সালে মারা যান। মৃত্যুকালে তাদের কোন সন্তান ছিল না।

পরবর্তীতে তিনি প্রায় এক বছর ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং নেপাল ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি বৌদ্ধধর্মীয় বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও মঠ পরিদর্শন করেন।

এরপর তিনি ১৯৮৫ সালের শেষ থেকে ১৯৮৯ সালের প্রথম পর্যন্ত ওয়াশিংটন স্কুল অব মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি, বি. অ্যালান ওয়ালেস এবং ধর্ম ফ্রেন্ডশিপ ফাউন্ডেশন ধর্মশালা থেকে একজন লামা, জেনারেল লামরিম্পাকে দুই বছরের জন্য সিয়াটলে আসার জন্য একপ্রকার বাধ্য করে। সিয়াটলে কারজিন জেনারেল লামরিম্পার ড্রাইভার হিসাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

১৯৮৮ সালে জেনারেল ল্যামরিম্পা ভারতে ফিরে আসেন। জেনারেল ল্যামরিম্পাকে সংঘ দিতে কারজিন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছয় মাসের অনুপস্থিতির ছুটি চেয়ে আবেদন করেন। তার ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কারজিন আর ওয়াশিংটন ফিরে যাননি, তিনি ধর্মশালায় থেকে যান। সেখানে তিনি স্থানীয় সম্প্রদায়, দালাই লামা এবং অন্যান্য তিব্বতি লামাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান শুরু করেন।

ধর্মশালায় কারজিন, নিবিড়ভাবে বৌদ্ধধর্ম এবং ধ্যান অধ্যয়ন শুরু করেন। ধর্মশালায় যাওয়ার ১৯ বছর পর (২০০০-এর দশকের প্রথম দিকে), তিনি ফেব্রুয়ারী ২০০৩ সালে দালাই লামার কাছে ভিক্ষুত্ত্ব প্রার্থনা করেন এবং একজন ভিক্ষু হিসাবে নিযুক্ত হন। ধর্মশালায় তিনি তার ডাক্তার হিসাবে দালায় লামা ও অন্যান্য লামাদের যত্ন নেওয়া শুরু করেন। তার কর্মজীবন জুড়ে, কারজিন আমেরিকান বোর্ড অব ফ্যামিলি মেডিসিনের সাথে তার বোর্ড সার্টিফিকেশন বজায় রেখেছেন।

২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, তিনি উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে রিচার্ড জে ডেভিডসনের নেতৃত্বে মস্তিষ্কে ধ্যানের প্রভাব সম্পর্কে স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণায় একজন গবেষক হিসেবে কাজ করেন।

কারজিন ২০১০ সালে জাপানে মানবিক মূল্যবোধ ইনস্টিটিউট (Human Values Institute) প্রতিষ্ঠা করেন এবং ২০০৭ সাল থেকে সেখানে নিয়মিত শিক্ষাদান শুরু করেন। তিনি Human Values Institute এর চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তার পরিচালিত ইনস্টিটিউট এর হয়ে সে বই প্রকাশ, নির্দেশমূলক চলচ্চিত্র প্রকাশ, বক্তৃতা প্রদান, কর্মশালায় নেতৃত্ব এবং ধ্যান রিট্রিট করেন। টোকিওতে একটি বার্ষিক সিম্পোজিয়াম আয়োজন করেন এবং শিকোকু দ্বীপে তীর্থযাত্রার নেতৃত্ব দেন। তার দেওয়া শিক্ষা স্বাস্থ্য, শারীরিক ও মানসিক জীবনযাপন এবং মৃত্যুকে সহানুভূতির সাথে পরিচালনার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।

২০১১ সালের টোহোকু ভূমিকম্প এবং সুনামির পরপরই তিনি টোকিওর গোকোকুজি মন্দিরে হার্ট সূত্র সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছিলেন।

২০১৪ সালে, কারজিন তার মাতৃভূমি আমেরিকাতে Altruism in Medicine Institute (AIMI) প্রতিষ্ঠা করেন। তার লেখা নিবন্ধগুলির মধ্যে ”দালাই লামার ডাক্তারের পিটসবার্গের জন্য একটি বার্তা” এবং ”দালাই লামার চিকিত্সকের কাছ থেকে ছুটির চিন্তা” অন্যতম।

২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ডিপমাইন্ড (একটি অ্যালফাবেট গ্রুপ কোম্পানি) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য বৌদ্ধ দর্শনের উপর ভিত্তি করে ২দিনের প্রোগ্রাম ডেভেলপিং অলট্রুইস্টিক অ্যালগরিদম নাম একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে, সেখানে কার্জিন পরিচালকের ভূমিকা পালন করেন।

কারজিন ২০১১ সালে লাইপজিগের ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান কগনিটিভ অ্যান্ড ব্রেন সায়েন্সেস-এর বিজ্ঞানীদের দ্বারা আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য ছিল, মানব আচরণ এবং আবেগ পরিবর্তনে সহানুভূতির ভূমিকা অন্বেষণ করা। কর্মশালাটি একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম এবং একটি মাল্টিমিডিয়া বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যাতে কারজিন দুটি অধ্যায়ে অবদান রাখতে সক্ষম হন।

২০০৬ সালে কারজিন ভারতের বারাণসীর সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অফ তিব্বত স্টাডিজ-এ ভিজিটিং প্রফেসরশিপ পেয়েছিলেন। হংকং ইউনিভার্সিটিতে তিনি ২০১৪ এবং ২০১৫ এর জন্য ‘মেডিসিনের ভিজিটিং প্রফেসর’ নিযুক্ত হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ অধ্যায়নের অনারারি প্রফেসর নিযুক্ত হন।

Barry Michael Kerzin
Barry Michael Kerzin

কেরজিন মাইন্ড অ্যান্ড লাইফ ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো। মাইন্ড অ্যান্ড লাইফ ইনস্টিটিউট ১৯৮৫ সালে বৌদ্ধ পণ্ডিত এবং পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের মধ্যে একটি সংলাপকে উত্সাহিত করার জন্য কাজ শুরু করেছিল।

মেডিসিন ইনস্টিটিউটের (AIMI) এর সদর দফতর পিটসবার্গে স্থানান্তরিত করার উপলক্ষ্যে, ডক্টর কারজিন পিটসবার্গের মেয়র মিঃ উইলিয়াম পেডুটোর কাছ থেকে একটি ঘোষণা পেয়েছেন। ডক্টর কারজিন এবং এ AIMI-এর কাজকে সম্মান জানানোর জন্য মেয়র উইলিয়াম পেডুটো ১৯ নভেম্বরকে “Altruism in Medicine Institute Day” হিসাবে পালন করার জন্য ঘোষণা দিয়েছেন।

উল্লেখযোগ্য কাজ

প্রকাশনা: কেরজিন বেশ কয়েকটি বই এর লেখক। তিনি নো ফিয়ার নো ডেথ: দ্য ট্রান্সফর্মেটিভ পাওয়ার অফ কমপ্যাশন নাগারজুনের উইজডম: এ প্র্যাকটিশনারস গাইড টু দ্য মিডল ওয়ে (প্রেস) উল্লেখযোগ্য।

দ্য তিব্বতিয়ান বুড্ডিস্ট প্রেসক্রিপশন ফর হেপিনেস (জাপানি ভাষায়); মাইন্ড অ্যান্ড ম্যাটার: দুই নোবেল বিজয়ীর মধ্যে সংলাপ (জাপানি ভাষায়)।

অধিকন্তু, কারজিন বিভিন্ন বইয়ের জন্য অনেক অধ্যায় লিখেছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশের রেডিও এবং টিভিতে অনেক সাক্ষাত্কার দিয়েছেন।

দেশনা: তিনি ২০১০ সালে হ্যাপিনেস, ২০১৪ সালে সমবেদনা এবং রাগ ব্যবস্থাপনার উপর এবং ২০২১ সালে পিটসবার্গ ‘টাইম ক্যাপসুল’-এ সমবেদনা এবং স্থিতিস্থাপকতার উপর বক্তৃতা দেন।

ডকুমেন্টারি: কারজিনকে ২০০৬ সালে ইউএস পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস ডকুমেন্টারি দ্য নিউ মেডিসিন শিরোনামে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এই টিভি ডকুমেন্টারিটি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক পর্যালোচনা পেয়েছে। পরে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ আরও ইতিবাচক পর্যালোচনা প্রকাশিত হয়েছে।

বর্তমানে তিনি বৌদ্ধধর্ম প্রসার ও প্রচারের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

আরো পড়ুন>>

 

শেয়ার করে সবাইকে পড়ার সুযোগ দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!