“আমি এবং সকল প্রাণী সবাই বোধিসত্ত্ব। এই সত্য অবগত হতে পেরে, মনকে পরমভাবে আলোকিত করত পেরেছি।”
“আমার সংঘের প্রার্থনা” বই থেকে আবৃত্তি করা এই দুটি লাইন বিশুদ্ধ উপলব্ধি করার এক দশক পরে, যখন সকালে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম তখন হঠাৎ বার্তাবাহী পাখির মতো কথাটি উড়ে এসে আমার হৃদয়ের প্রাণ কেন্দ্রে আঘাত করল। “এটাই,” হ্যাঁ শুধু এটাই আমার শিক্ষক বলতেন।”
একটি ঘরের ভিত্তি যেমন ঘরটিকে টিকিয়ে রাখে তেমনি এই প্রার্থনা বইয়ের উদ্ধৃতিটি মন্ত্রের মতো আমার শ্বাসের সাথে জড়িয়ে গেছে। ধ্যান করার সময় যখন আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি তখন সেই বাক্যগুলোই স্মরণ করি।
কি হয় ভাবুন তো, আমরা এবং অন্যরা সবাই “ভাবী বুদ্ধ”? আমাদের জন্মের আগে- পৃথিবী শুরুর আগেই আমরা প্রত্যেকে বুদ্ধ ছিলাম এবং আমাদের প্রত্যেকেরই সেই গুণ আছে, সেই সম্ভাবনা রয়েছে? কীভাবে আমাদের অভিজ্ঞতা অন্যান্য প্রাণীর সাথে মিথস্ক্রিয়া, সহমর্মিতার জন্য আমাদের ক্ষমতাকে পরিবর্তন করে? এমনকি যদি এটিকে বিশ্বাসের সাথে গ্রহণ করি এবং ধৈর্য সহকারে পরীক্ষামূলকভাবে জাগ্রত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করি?
একটা ঘটনা বলি। স্টেট হাউস, যেটি আমার খুব পরিচিত জায়গা, যেখানে আমি আগেও সেবা দিয়েছি। বছরখানেক আগে যখন আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে আইনসভার বিতর্ক দেখার জন্য ভ্রমণ করেছিলাম দিনটির কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন তৎকলীন স্পিকারকে অতিশ দিপংকরের চা বালকের মতো মনে হয়েছিল। একাদশ শতাব্দীর বৌদ্ধ ভিক্ষু আতিশ দিপংকর যখন তিব্বত ভ্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন, তিনি শুনেছিলেন যে তিব্বতীরা নরম মনের মানুষ। আসার সময় তিনি সাথে করে এক দুষ্ট ছেলে নিয়ে এসেছিলেন যাতে তাঁকে চা পরিবেশন করতে এবং তাঁকে জাগ্রত রাখতে পারে।
সেদিন যখন আমাদের স্পেশাল বিলটি হাউজে রি-কল করছিলাম না, উপস্থিত বেশিরভাগ সদস্য জনগণের পক্ষে মতামতটির সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আমার সাথে যোগ দিয়েছিরলেন। হাউজ মধ্যাহ্নভোজনে যাওয়ার সময়, আমাদের পক্ষের একদল ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে জনগণকে আমাদের অকসন্তুষ্টির কথা ঘোষণা করতে লাগলো।
হঠাৎ চাপিয়ে দেওয়া সামনের দরজাটি যখন খুলে গেল আমরা অবাক হয়ে দেখলাম স্পিকার একা আসলেন। এসে তিনি শুধু বললেন তাকে তারমতো করে আগে ভাবতে হবে। পূর্বে এ বিষয়ে কি হয়েছিল তা আলোচনা করতে হবে, একথা বলেই হাঁটতে শুরু করলেন তিনি।
আমাদের দলটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ্য করে জোরে জোরে আওয়াজ করতে লাগল। সেই রাজনৈতিক বিক্ষোভে অপরিচিত কেউ ছিল না। আমিও তাদের সাথে চিৎকারে যোগ দিয়ে আমাদের কাঙ্খিত শব্দ নিক্ষেপ করতে লাগলাম। আমাদের প্রতিবাদ শেষ পযর্ন্ত আইনসভা এবং আমাদের চাওয়ার মাঝামাঝি অবস্থানে দাঁড়িয়েছিল। তিনি যতই হাঁটতে থাকালেন আমরা আরো চিৎকার করতে থাকলাম।
সেদিন আমি রাগে পাগলের মতো আচরণ করছিলাম। আমার চারপাশের মানুষের গুলোর প্রতি খুব রাগ, বিরক্তি এবং খারাপ আচারণ করছিলাম যা আমার কাছ থেকে কেউ আশা করেনি। এটি এতই বিষাক্ত ছিল যে আমার চারপাশে একটি অন্ধকার কাফনের সৃষ্টি করতে শুরু করে।
রাগারাগির সয়য়টি খুব অল্প ছিল, মাত্র ২মিনিটের ব্যাপার কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে এটি চলছে। আমার চোখ থেকে অশ্রু বয়ে যেতে শুরু করল। আমি যে শব্দগুলি চেঁচিয়ে যাচ্ছিলাম সেগুলি আমার গলায় আটকে যাচ্ছিল, আমি আর পারছিলাম না এবং আমার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছিল।
আমি বুঝতে পারছিলাম আমি যা আচারণ করছিলাম সেটি আমার ভিতরের আমি ছিলাম না। সেটি অন্য এক আমি হয়ে গেছিলাম। আমি ভুলে যেতে বসেছিলাম যে এক সময় তার আর আমার মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব ছিল।
পরে আমি চেঁচামেচি থামালাম, অশান্তি থেকে সরে গেলাম, এবং বাড়ি যাওয়ার জন্য নিজের গাড়িতে ফিরে গেলাম। পার্কিং-এ যাওয়ার পথের লোকটির ব্যাপারে বিদ্রুপ করে আবারও একই ঘটনা ঘটালাম। তাকে পিছনের দিক থেকে দেখে ভাবলাম, এই সে ব্যক্তি যে আমার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যে আমাদের বিপক্ষে শাসন পরিচালনা করতে চায়, কি আশ্চার্য এখনো যে বেঁচে আছে, এখনও সে, হাঁটছে, চিন্তা করতে পারছে, সব কিছু আমার মতোই, সেও কিনা আমার সুখ চায়।
তিনি তার রাজনৈতিক দর্শনের উপর ভিত্তি করে সংবিধান প্রণয়ন করার ইচ্ছা নিয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন এবং জিতেছিলেনও। আমিও চেয়েছিলাম সেটা কিন্তু আমার মতাদর্শ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি তাকে হারাতে পারিনি।
চোখের জল মুছেতে মুছতে চিন্তা করলাম কী ঘটেছে আমার সাথে এটা? আমি বৌদ্ধ শিক্ষা এবং ধর্মীয় অনুশীলনের পাশাপাশি বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে বিপ্লব করেছিলাম। এমন কি আমি সবাইকে আঘাত করে ছিলাম এবং আমার নিজের চা বালকও আমার দ্বারা কষ্ট পেয়েছিল।
তবে বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি ধার্মীক হিসেবে নিজেকে যা ভাবতাম তা থেকে আমি সরে গেছিলাম। বুঝলাম আমি অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিক্ষোভে মেতে উঠেছিলাম। আমাদের ধারনা ছিল তিনি ভুল ছিলেন এবং আমরা সঠিক ছিলাম। তাকে শত্রু ভেবে নিজের দুঃখ যেমন সৃষ্টি করলাম তেমনি তার মনেও কষ্ট দিলাম।
আমরা মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করি। একটি হলে নিজের মতের, নিজের জাত অন্যটি শুধুই শত্রু। প্রতিদিন আমেরিকার দুটি বড় রাজনৈতিক দলকে দেখি কীভাবে একটি আবদ্ধ চক্রে দুইজন মুষ্টি যোদ্ধার মতো শক্তিশালী লড়াইয়ে অবর্তীন হয়। আমরা দেখি কিভাতে তারা নিজের জয় পাওয়ার জন্য একে অপরেকে শত্রু ভাবে।
গত বছর জুম এপ্স এর এক আলোচনায় অন্তর্দৃষ্টি মেডিটেশনের শিক্ষক জোসেফ গোল্ডস্টেইনকে কেউ একজন জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, “আমাদের দেশের নেতৃত্বদানকারী জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের জন্য কেউ কি মৈত্রী ভাবনা প্রার্থনার আয়োজন করতে পারে?
জোসেফ গোল্ডস্টেইন তাদের প্রস্তাব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, “আপনি ঘৃণা থেকে মুক্ত থাকুন; আপনার হৃদয় প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ হউক।” আমরা নিজেোও এই প্রার্থনাটি সবসময় করতে পারি।
আমার কাছে এটি স্পষ্ট যে, চিৎকার করার সময় আমি দেহ ও মনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম। যখন আপনি রাগান্বিত হন তখন কিছুই শিথিল ও মন উদার থাকে না সব সংকোচিত হয়ে যায়। রাগে যখন আমাদের মানসিক সংকোচন ঘটে তখন আমাদের কর্মের প্রভাব কি হবে সেটি আমরা ভুলে যাই। তখন আমরা গভীরভাবে নিজের স্বার্থের ভিতর থাকি এবং আন্তঃবিযুক্ত হতে পারি না।
কেবলমাত্র একটি উন্মুক্ত হৃদয় দিয়েই আমরা অন্যান্য সংবেদনশীল প্রাণীদের সাথে, আমাদের বাসযোগ্য গ্রহের সাথে এবং সকলের সম্মিলিত আলোকিত মনের প্রশস্ততা দিয়ে, আমাদের চারপাশ এবং পরম অস্তিত্বের সাথে আমাদের আন্তঃসংযোগ অনুভব করতে পারি।
আমি যে স্টেট হাউসের স্মৃতি বর্ণনা করেছি তাতে একাধিক বৌদ্ধ শিক্ষার নমুনা পাওয়া যায়, যেমন সম্যক বাক্য, রাগ না করা, সকলের প্রতি মৈত্রী ভাব হওয়া, সম্যক দৃষ্টিভঙ্গি, কর্ম ও কর্মফল সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং পঞ্চশীল।
ট্রাই-সাইকেল ওয়েবসাইটে লেসলি বুকারের সাম্প্রতিক ধর্ম আলাপে তিনি বলেছিলেন, “…যখন আমরা বুঝতে পারি যে আমরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল তখন আমাদের মধ্যে একটি আবেগ কাজ করে।” নিজের বা অন্যের জন্য যখন মমত্ববোধ আসে তখন আমরা সেই স্পর্শকাতরতাটি স্পর্শ করতে পারি।
যখন আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের বা অন্যের ক্ষতি হয়েছে তখন আমরা অনুশোচনা করি। ভাবুনতো যখন আমরা কারো ক্ষতি করি বা কারো উপর রাগ প্রদর্শন করি তখন তার কেমন লাগে? ঠিক আমার যেমন খারাপ লাগে তেমনি অন্যদেরও খারাপ লাগে, দুঃখ হয়।
শুধু বিছানায় শুয়ে শুয়ে নয় এই কোমলতা এই উন্মুক্ততা আমাদের সব সময় অবলম্বন ও অভ্যাস করতে হবে। আমরা যে সবাই ভাবি বুদ্ধ, আমাদের মধ্যে যে বুদ্ধ গুণ নিহিত আছে তা বিশ্বাস ও প্রত্যক্ষ করার এটি প্রথম পদক্ষেপ। সবসময় আমাদের মধ্যে বিদ্যমান আলোকিত চেতনা দ্বারা সবার সাথে একই রকম sআচারণ করবো যা আমাদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক সৃষ্টি করবে।
আরো>>