তালেবান আফগানিস্তানে বৌদ্ধ ঐতিহ্য তত্ত্বাবধানের বৈধতা চায়

ক্ষমতায় ফিরে আফগানিস্তানের তালিবান সরকার তাদের দেশে বিদ্যমান অমূল্য বৌদ্ধ ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের সংরক্ষনের দিকে নজর দিয়েছেন। তারা দেশটির বৌদ্ধ ঐতিহ্য রক্ষায় তত্ত্ববধানের বৈধতা চায়।

২০০১সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দীর্ঘ ২০ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে তালেবান আফগানিস্তানে বিদ্যমান অমূল্য বৌদ্ধ ঐতিহ্যের নতুন রক্ষক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে।  ইতোমধ্যে তালেবান হেফাজতের অধীনে যেসব বৌদ্ধ ঐতিয্য এসেছে তার মধ্যে রয়েছে বামিয়ান বুদ্ধমুর্তি এবং আফগানিস্তানের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত বৌদ্ধ স্থাপনা।

চলতি বছর ১৫ আগস্ট রাজধানী কাবুলের দখল নেওয়ার পর থেকে তালেবান দরিদ্র, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে শাসন করতে প্রচণ্ড অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে। মৌলিক অবকাঠামো এবং সরকারি পরিষেবাগুলো ছাড়াও তালেবান আফগানিস্তানের সমৃদ্ধ ইতিহাস, বিশেষত বৌদ্ধ সংস্কৃতি সহ যা অবশিষ্ট আছে তা সংরক্ষণের লাগাম নিতে হয়েছে।

তালেবান তাদের পূর্বের গুড়ামি থেকে অনেকটা সরে এসেছে। তারা আগের মতো জনসাধারণকে মিউজিয়াম ভ্রমণ ও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনা ভ্রমণে তুলনামূলক কম বাঁধা প্রদান করছেন। গত ২৫ নভেম্বর আফগানিস্তানের ন্যাশনাল মিউজিয়ামটি পুনরায় চালু করার মাধ্যমে তাদের ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে।

আর্টনেটের গত বুধবার রিপোর্ট অনুযায়ী, মিউজিয়ামটি সম্পূর্ণ তালেবান সুরক্ষায় পুনরায় চালু হয়েছে। জাদুঘরটিতে প্রতিদিন ৫০-১০০ জন দর্শনার্থী ভ্রমণ করছেন যাদেরকে তালিবান সুরক্ষা দিতে দেখা গেছে। উল্লেখ্য, আফগানিস্থান জাতীয় জাদুঘরের অধিকাংশ সংগ্রহ বৌদ্ধ ঐতিয্য বহন করে, যেখানে বৌদ্ধের মুর্তি ও অন্যান্য স্মৃতি সংরক্ষিত আছে।

National Musiam of Afganistan
আফগানিস্তা জাতীয় জাদুঘর

বিখ্যাত গবেষণা এবং একাডেমিক প্রতিষ্ঠান অর্টনেটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাদুঘরের পরিচালক মোহাম্মদ ফাহিম রহিমি প্রথমে ভয় পেয়েছিলেন যে তালেবান হয়তো মিউজিয়ামটি ধ্বংস করে দিবে। কারন তালেবানরা ২০০১ সালে জাদুঘরটির নির্মম ভাংচুর করেছিল। ২০০১ সালের ভাংচুরে প্রায় ১০০,০০০টি মূল্যবান সংগ্রহ ধ্বংস ও লুট করা হয়েছিল। বর্তমানে যাদুঘরটিতে প্রায় ৫০,০০০টি নিদর্শন রয়েছে যা ইউনেস্কোর সহায়তায় পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।

কাবুল চুড়ান্ত দখলের পরও যখন তালেবান জাদুঘরে আক্রমণ করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, তখন রহিমি যেন প্রাণ ফিরে পায়। রহিমি তখন মিউজিয়ামটি পাহারা দেওয়ার জন্য পাহারাদারের তালিকা তৈরী করে।

২০০১ সালে বামিয়ানে তালেবানরা যে জায়গাটি ধ্বংস করেছিল তার সুরক্ষার আন্তরিকতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে গেছে। বামিয়ান এখনো আফগানিস্তানের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র, যেখানে দর্শনার্থীদের প্রবেশ মূল্য হিসেবে US$5 পরিশোধ করতে হয়।

তালেবান সরকারের সদস্য না একজন তালেবান সমর্থক বিধ্বস্ত বুদ্ধমুর্তিকে দেখতে গিয়ে এনবিসি নিউজকে বলেছেন, “এগুলো ধ্বংস হওয়ার সময় আমি অনেক ছোট ছিলাম, আমার বয়স তখন প্রায় ৭ বছর। তখন থেকে এখানে কি ঘটেছিল তা দেখার স্বপ্ন ছিল . . . .। আমি খুশি যে এটিকে ধ্বংস করা হয়েছে। আমি এখানে আসলে ধ্বংসাবশেষ দেখতে এসেছি।”

২০০১ সালে তালেবানরা যখন ভাস্কর্যগুলিকে “অ-ইসলামিক” ঘোষণা করে বিস্ফোরণ ঘটায় তখন বামিয়ান বুদ্ধমুর্তি ও সেই এলাকার বৌদ্ধদের দুর্দশা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়লেও প্রকৃত পক্ষে কোন লাভ হয়নি।

তবে আশার বিষয় হলো এবার তালেবান ক্ষমতায় এসে অনেকটা কম মৌলবাদী, অনেকটা উধার সরকারের ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে  তালেবানের অধীনে আফগানিস্তানের সামাজিক অগ্রগতি পিছিয়ে যাবে না।

দেশটির দখলের আগে, তালেবান একটি বিবৃতিতে জানিয়েছিল যে, তারা গুরুত্বপূর্ণ স্থান লুট করবে না এবং একই বিবৃতিতে আফগানিস্তানের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

বিবৃতিতে উল্লেখ ছিল, “যেহেতু আফগানিস্তান একটি প্রাচীন নিদর্শন এবং পুরাকীর্তি দ্বারা পরিপূর্ণ দেশ, এই ধরনের ধ্বংসাবশেষগুলি আমাদের দেশের ইতিহাস, পরিচয় এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতির একটি অংশ, তাই এই নিদর্শনগুলিকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করা, নিরীক্ষণ করা এবং সংরক্ষণ করা সকলেরই কর্তব্য।”

আগস্টে তালেবানরা পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা গ্রহণ করলে, ইউনেস্কো বামিয়ান বুদ্ধের মতো স্থান সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি জারি করে। ইউনস্কো তাদের বিবৃতেতে জানায়: “আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য এই ল্যান্ডমার্কগুলিকে রক্ষা করা এবং সংরক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

দ্য অ্যালায়েন্স ফর দ্য রিস্টোরেশন অফ কালচারাল হেরিটেজ ইন্টারন্যাশনাল (এআরসিএইচআই) আফগানিস্তানের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য তালেবানদের সাথে লবিং করার জন্য ইসলামিক ধর্মতত্ত্ববিদদের সাথেও যোগাযোগ করেছে।

ARCH-এর প্রেসিডেন্ট শেরিল বেনার্ড তালেবানের এই দলটিকে “আশ্চর্যজনকভাবে গ্রহণযোগ্য” বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “শেষ পর্যন্ত, আমরা এমনটা আশা করিনি। তাদের নিজস্ব উদ্যোগে, এমনকি মাঠ পর্যায়ে তাদের কমান্ডারদের কাছে একটি আদেশ পাঠিয়েছিল যেন কোনো ঐতিহাসিক স্থান বা স্থাপনা ধ্বংস না করে এবং লুটপাট প্রতিরোধ করে।”

 

আরো পড়ুন>>

শেয়ার করে সবাইকে পড়ার সুযোগ দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!