ভিয়েতনামে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস

ভিয়েতনামের বর্তমান মোট জনসংখ্যা ৮৭,৮৫০,০০০ যার মধ্যে বৌদ্ধধর্ম পালন করেন ১৪,৩৮০,০০০ জন মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬.৪০% মানুষ বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী।

ভিক্ষু থিচ নাহাত এর হাত ধরেই ভিয়েতনামে বৌদ্ধধর্মের আগমন হয়েছিল। আনুমানিক ১৮ শতকের আগে ভিয়েতনামে বৌদ্ধধর্ম একটি গ্রহণযোগ্য ধর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ভিয়েতনামে সাধারণত মহাযান বৌদ্ধধর্ম অধিক প্রচলিত যা ভিয়েতনামকে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার থেরবাদী বৌদ্ধ দেশ গুলো থেকে আলাদা ভাবে পরিচিত করেছে। বেশিরভাগ ভিয়েতনামী মহাযান বৌদ্ধধর্মাবলম্বী চান (জেন) অনুসরণ করেন তাদের মধ্যে আবার স্থানীয় টিয়ান-টাই প্রভাবও রয়েছে। ভিয়েতনামের খমের জাতিগুষ্টির সংখ্যালঘু উপজাতিদের মধ্যে থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম পরিলক্ষিত হয়।

গত ৫০ বছর ধরে ভিয়েতনামে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ একাধিক সরকারী নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ভিক্ষু সংঘের বেশ কিছু সদস্যকে প্রতিনিয়ত হয়রানী, ভয় দেখানো এবং আটক করছে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি।

ভিয়েতনামে বৌদ্ধধর্মের আগমন ও বিকাশ

খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর পর বৌদ্ধধর্ম ভারত এবং চীন থেকে ভিয়েতনামে পৌঁছেছে বলে মনে করা হয়। সে সময় থেকে দশম শতাব্দী অবধি বর্তমান ভিয়েতনাম চীনের অধীনস্ত একটি প্রদেশ ছিল। ভিয়েতনামে বৌদ্ধধর্ম মূলত চীনা প্রভাব নিয়ে বিকশিত হয়েছে।

একাদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভিয়েতনামে বৌদ্ধধর্ম শাসক শ্রেণীর অনুগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এই সময়কে ভিয়েতনামে বৌদ্ধধর্মের স্বর্ণযুগ বলা হয়। লি রাজবংশের তত্ত্ববধানে ১৪২৮ থেকে ১৭৮৮ পর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম তার নিজস্ব মহিমায় ভিয়েতনামের আনাচে কানাচে বিকাশ লাভ করে।

ফ্রেঞ্চ ইন্দোচীনা এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধ

ভিয়াতনামী ইতিহাসের পরবর্তী অংশটি সরাসরি বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে নয়, তবে ভিয়েতনামী বৌদ্ধধর্মের প্রসারে ঘটনাগুলো অত্যান্ত প্রাসঙ্গিক।

১৮০২ সালে ফ্রান্সের হস্তক্ষেপে গুইন রাজবংশ ক্ষমতায় আসে। তখন থেকে ফরাসি ক্যাথলিক মিশনারি এবং ফরাসিরা ভিয়েতনামে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রভাব বিস্তারের জন্য জোর চেষ্টা করে। পরে তৃতীয় নেপোলিয়ন ভিয়েতনাম আক্রমণ এবং ভিয়েতনামকে ফরাসী অঞ্চল হিসাবে দাবি করে। ১৮৮৭ সালে ভিয়েতনাম ফ্রেঞ্চ ইন্দোচীনের অংশে পরিণত হয়।

১৯৪০ সালে জাপান ভিয়েতনাম আক্রমণ করে কার্যকরভাবে ফরাসি শাসনের অবসান ঘটান। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান পরাজিত হলে, ভিয়েতনামের রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থার একটি জটিল রূপ ধারন করে। ভিয়েতনামে একপ্রকার গৃহ যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভিয়েতনামের উত্তর অংশ ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি (ভিসিপি) নিয়ন্ত্রণ করছিল আর দক্ষিণ অংশ বিদেশী সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। ১৯৭৫ সালে সাইগনের পতনের আগ পযর্ন্ত এভাবেই চলছিল ভিয়েতনামের শাসন ব্যবস্থা।

ভিয়েতনামে বৌদ্ধ সংকট এবং থিচ কোয়াং ডোক

এবার একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক। ১৯৬৩ সালের বৌদ্ধ সংকট, যা ভিয়েতনামী বৌদ্ধ ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

১৯৫৫ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ ভিয়েতনামের ক্ষমতায় আসেন এনগো দিংহ ডেইম। প্রেসিডেন্ট এনগো দিংহ ডেইম ক্যাথলিক খ্রিষ্টান দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তাই তিনি ভিয়েতনাম জুড়ে ক্যাথলিক নীতি অনুসারে পরিচালনা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বদ্ধ হন। সময়ের সাথে সাথে ভিয়েতনামের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বুঝতে পারলেন ডেইমের ধর্মীয় নীতিগুলি অন্যায় ও খামখেয়ালীভাবে অন্যের উপর চাপি দিচ্ছে।

১৯৬৩ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট ডাইমের ভাই ভিয়েতনামের হিউতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান অনুষ্ঠান ভেসাক ডে উপলক্ষে বৌদ্ধ পতাকা উড়াতে নিষিদ্ধ করেন। বৌদ্ধরা এর বিরোধীতা করে বিক্ষোভ করলে সামরিক বাহিনী দ্বারা তাদের দমন করা হয়। সামরিক বাহিনীর আক্রমনে নয়জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ডাইমে এর জন্য উত্তর ভিয়েতনামকে দোষারোপ করে এবং পুণঃ বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেন যা বিক্ষোভকে আরো তীব্র করে তুলেছিল।

Buddhist history on Vietnam
Monks protest against the Ngo regime. Thich Nhat Quang sits here on the left.

১৯৬৩ সালের জুনে সায়গনের থাইচ কোয়াং ডুক নামে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ধ্যান ভঙ্গিতে বসে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন। থিচ কোয়াং ডুকের আত্ম-দংশনের ছবিটি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আইকনিক চিত্র হয়ে ওঠে। যা বিশ্ব জুড়ে আলোচনার ঝড় তুলেছিল।

এদিকে, অন্যান্য বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণী ও সাধারণ বৌদ্ধরা র‌্যালি ও অনশন ধর্মঘট পালন করে। তারা ডাইমের বৌদ্ধবিরোধী নীতির প্রতিবাদ জানিয়ে প্রচারপত্র বিলি করতে থাকে। ডাইমের প্রতি সাধারণ জনগণের উদ্বেগ প্রকাশ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বিক্ষোভগুলি পশ্চিমা মিডিয়ার বিশিষ্ট সাংবাদিকরা মূলধারার প্রচার মাধ্যমে প্রচার করে। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এনগু দিংহ ডাইমের কর্ম কান্ডকে সমর্থন করেছিল।

একই বছরের আগস্ট মাসে ডাইমের ভাই ভিয়েতনামের গোপন পুলিশ প্রধান, এনগু দিংহ নুহ ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ বন্ধ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। সে সমগ্র দক্ষিন ভিয়েতনামের বৌদ্ধ মন্দির গুলো আক্রমণ করা জন্য ভিয়েতনামের বিশেষ বাহিনী ও সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিল। সেই ঘৃণ্য আক্রমনে ১,৪০০ এরও বেশি বৌদ্ধ ভিক্ষুকে গ্রেপ্তার করা হয়, শতাধিক নিখোঁজ হয়। এর পরে নিখোঁজ কাউকে পাওয়া যায়নি ধারনা করা হয় তাদের হত্যা করা হয়েছিল।

Buddhist History in Vietnam

বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে এতটাই বিরক্তি করেছিল যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র নুহ সরকারের কাছ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল। পরে সেই বছরই এক সামরিক অভ্যূত্থানে ডাইমেকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

থিচ নাথ হানহ

ভিয়েতনামে আমেরিকার সামরিক সম্পৃক্ততার একটি উপকারী প্রভাব ছিল। সে সময় বৌদ্ধ ভিক্ষু থিচ নাথ হানহ (জন্ম: ১৯২৬) বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৬৫-৬৬ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামে দলে দলে মার্কিন সৈন্যরা প্রবেশের করে। সে সময় নাথ হানহ সাইগনের একটি বৌদ্ধ কলেজে শিক্ষকতা করছিলেন। তিনি এবং তার ছাত্ররা শান্তির আহ্বান জানিয়ে বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতি দিয়েছিল।

১৯৬৬ সালে নাথ হানহ যুদ্ধের উপর বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি আমেরিকান বিভিন্ন নেতাদের সাথে দেখা করেন। ভ্রমণ শেষে তাকে আর উত্তর বা দক্ষিণ ভিয়েতনামের কোন শাসক কেউই তাকে দেশে ফিরে যেতে দেয়নি। পরে তিনি ফ্রান্সে চলে যান এবং সেখানে পশ্চিমা বৌদ্ধধর্মের অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন।

বর্তমনা ভিয়েতনামে বৌদ্ধধর্ম

ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধান ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টিকে ভিয়েতনামের সরকার এবং সমাজের সর্বময় ক্ষমতার মালিক করে দিয়েছে। এমন কি বৌদ্ধধর্মের উপরও তারা ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে।

ভিয়েতনামে প্রধান দুটি বৌদ্ধ সংগঠন রয়েছে— ১টি হলো সরকার অনুমোদিত Buddhist Church of Vietnam (BCV) অপরটি স্বাধীন Unified Buddhist Church of Vietnam (UBCV)। BCV “ভিয়েতনামি ফাদারল্যান্ড ফ্রন্ট” এর একটি অংশ যা তাদের দলকে সমর্থন করার জন্য সাজানো হয়েছে। UBCV সংগঠনটি BCV-তে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায় তাই UBCV সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ।

৩০ বছর ধরে সরকার UBCV ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের হয়রানি ও আটক করছে এবং তাদের মন্দিরে অভিযান চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। UBCV নেতা থিচ কোয়াং ডো (৭৯) বিগত ২৬ বছর ধরে গৃহবন্দী হয়ে আছেন।  ভিয়েতনামের বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং সন্ন্যাসীদের উপর সরকারি আচরণ বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংস্থাগুলির জন্য এক গভীর উদ্বেগ হিসাবে রয়ে গেল।

আরো পড়ুন>>

বৌদ্ধ বার্তা
শেয়ার করে সবাইকে পড়ার সুযোগ দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!